Bangla Jago Desk, Mou Basu : কথায় বলে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। জৈষ্ঠ্যমাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে সাড়ম্বরে পালিত হয় জামাইষষ্ঠীর আচার অনুষ্ঠান। এদিন শাশুড়ি মায়েরা আদরের জামাইয়ের কল্যাণার্থে পুজো দেন এবং জামাই আদর করার পর তবেই খাবার খান। অনেকেই এদিন অন্ন বা আমিষ খান না। এই দিনটি শুধু শাশুড়ি বা জামাইকে ঘিরে তৈরি হওয়া একটি উৎসব নয়, এই উৎসবটি দুটি পরিবারের মিলন উৎসব। বৈদিক যুগ থেকে শুরু হয় জামাইষষ্ঠী পালন। অনেকে এই ষষ্ঠীকে অরণ্য ষষ্ঠীও বলে থাকে। প্রাচীন অরণ্য ষষ্ঠী থেকেই শুরু হয় জামাইষষ্ঠী।
জামাইষষ্ঠীব্রত পালনের পেছনে রয়েছে এক পৌরাণিক কাহিনি। কাহিনি অনুসারে এক পরিবারে দুই বউ ছিল যার মধ্যে ছোট বউ ছিল অত্যন্ত লোভী। ভালো-মন্দ রান্না হলে সে সবার খাবার আগেই খেয়ে নিত। তাঁর শাশুড়ি পরে তাকে জিজ্ঞেস করলে সে কালো বেড়ালের নামে দোষ দিত। এদিকে, বেড়ালকে বলা হয়ে থাকে মা ষষ্ঠীর বাহন। বারবার মা ষষ্ঠীর বাহনের নামে মিথ্যা কথা বলায় রুষ্ট হন মা ষষ্ঠী। তাঁর অভিশাপে ছোট বউয়ের যতবারই সন্তান হয় জন্মের পর তাদের মৃত্যু হয়। এভাবে ছোট বউয়ের সাত পুত্র সন্তান ও এক কন্যা সন্তানের মৃত্যু হয়। ছোট বউ মনের দুঃখে বনে গিয়ে কাঁদতে শুরু করলে তার যন্ত্রণায় কাতর হয়ে মা ষষ্ঠী বৃদ্ধার ছদ্মবেশে তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন এবং কেন কাঁদছে জিজ্ঞেস করার ছোট বউ তার নিজের জীবনের কাহিনি খুলে বলে মা ষষ্ঠীকে। তার অন্যায় আচরণের কথা স্বীকার করে সে বারবার মা ষষ্ঠীর কাছে ক্ষমা চায়, তখন মা ষষ্ঠী নিজের স্বরূপে ফিরে আসেন এবং ক্ষমা করে দেন ছোট বউকে। সেই সঙ্গে বলেন যে জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লপক্ষে ষষ্ঠী তিথিতে ভক্তি ভরে মা ষষ্ঠী পুজো করতে তবেই সে তার নিজের মৃত সাত পুত্র ও কন্যার জীবন ফিরে পাবে। এরপর ছোট বউ মা ষষ্ঠীর কথা মত বাড়িতে ফিরে মা ষষ্ঠীর ভক্তি সহকারে পুজো করে এবং নিজের সব পুত্র কন্যাদের ফিরে পায়। সেই সময় থেকেই ষষ্ঠী পুজোর মাহাত্ম্য চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
[ আরও পড়ুন : T20 World Cup : কানাডার বিপক্ষে পাকিস্তানের আজ মরণ বাচন লড়াই ]
দেবী ষষ্ঠীর আশীর্বাদে যে সন্তান লাভ হয়, তা সকলেরই জানা। মা ষষ্ঠীর আশীর্বাদে মায়ের কোল আলো করে জন্ম নেয় সন্তান। তাই সন্তান লাভের আশায় বা সন্তানের কল্যাণের উদ্দেশ্যে বছরে ১২ টি ষষ্ঠী পালন করার রীতি ছিল গ্রাম বাংলায়। দুর্গা ষষ্ঠী, নীল ষষ্ঠীর মতোই এমন একটি ষষ্ঠী ছিল অরণ্য ষষ্ঠী। এক সময় অরণ্যের মাঝে এই ষষ্ঠী পালন করা হতো। অরণ্য না থাকলে বাড়ির উঠোন বা দালানকেও ছোটখাটো বাগান বানিয়ে সেখানে ব্রত পালন করতো বাড়ির মায়েরা। তবে এই অরণ্য সৃষ্টির সঙ্গে শুধুমাত্র সন্তানের মঙ্গল কামনাই জড়িয়ে রয়েছে তা নয়, এই রীতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে প্রকৃতির উদ্দেশ্যে আরাধনাও। কথিত রয়েছে, একবার দেবী ষষ্ঠী এক গৃহবধূকে শিখিয়েছিলেন অরণ্য ষষ্ঠী ব্রত পালন করার সমস্ত নিয়ম কানুন। ওই বিশেষ দিনে ব্রত পালন করার সময় ওই গৃহবধূ বাড়িতে ডেকেছিলেন নিজের মেয়ে এবং জামাইকেও। জামাই আসার পর দই-চন্দনের ফোঁটা দিয়ে জামাইকে আম কাঁঠাল খেতে বলেন ওই মহিলা। সেই থেকে অরণ্য ষষ্ঠীর সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেছে জামাইষষ্ঠীর নাম। আজও জ্যৈষ্ঠ মাসের ষষ্ঠী তিথিতে অরণ্য ষষ্ঠীর সেই রীতি একইভাবে পালন করে ঘরে ঘরে জামাইষষ্ঠী উদযাপন করা হয়।
[ আরও পড়ুন : হাইটেক যুগে সনাতনী প্রথায় জামাইষষ্ঠীর আয়োজন তুঙ্গে, বাজারে কদর বাড়ছে ফিউশন মিষ্টির ]
বছরের পর বছর ধরে বাংলার ঘরে ঘরে জামাইষষ্ঠী ব্রত পালন করে আসছেন বাঙালি ঘরের মায়েরা। প্রধানত ষষ্ঠী দেবীকে প্রসন্ন করার জন্যই এই উৎসবটি পালন করা হয়। এদিন শাশুড়িরা সারাদিন উপোস করে জামাইকে পাঁচ রকমের ফল, পান সুপারি, তালের পাখা, কুলো ইত্যাদি সরঞ্জাম সহকারে জামাই আপ্যায়ন করেন।তিনবার জামাইকে ‘ষাট’ বলেন শাশুড়িরা। মনে করা হয়, এর অর্থ হল, জামাইয়ের দীর্ঘায়ু কামনা করা। আশীর্বাদ করা হয়, ধান ও দূর্বা দিয়ে। উল্লেখ্য, ধান সমৃদ্ধির প্রতীক ও দূর্বা সতেজতার প্রতীক। সাধ্যমতো এলাহি আয়োজন করা হয় বাঙালি পরিবারে। হরেক রকম খাবারের মাধ্যমে জামাইয়ের আদর আপ্যায়ণ যত্ন করা হয়।