Bangla Jago Desk, Mou Basu : বৈশাখ, সূচনা আরও এক নতুন বছরের। বসন্তের মধ্যেই নিহিত বৈশাখের আগমন বার্তা। সেই পদধ্বনির মধ্যেই শুনতে পাওয়া যায় নতুন দিনের প্রত্যাশা, উদ্দীপনা আর শুভ সম্ভাবনা। পুরনো, জীর্ণ, শীর্ণ সব কিছুকে সরিয়ে শুভ মঙ্গলদীপকে জ্বালিয়ে রাখার গুরুভারটিও সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে নতুন বছরের আগমনে। ব্যবহারিক জীবনে নববর্ষের প্রথম দিনটি সারা বছরের জন্য জোগায় অক্সিজন। নববর্ষ মানেই আর একটি উত্সব। তা হল হালখাতা উত্সব। নতুন বছরের প্রথম দিনটি মানেই দোকানে দোকানে নতুন খাতা খোলা।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় বহু আগে বিনিময় প্রথার মাধ্যমে হালখাতার প্রচলন শুরু হয়। হিন্দু ধর্মে গাছ, পাথর, ইট, সবকিছুর ওপর ঈশ্বরের অস্তিত্ব আরোপ করা হয়। হালখাতার পুজোর সময় হালখাতার প্রথম পাতায় সিঁদুর, চন্দন লেপে প্রথমে বৈভব লক্ষ্মীর প্রতিকৃত আঁকেন পুরোহিত। লক্ষ্মী-গণেশের পুজো দিয়ে ব্যবসায়ীরা ব্যবসার খাতাপত্র শুরু করেন। নববর্ষ নিয়ে অনুষ্ঠানের আতিশয্য থাকলেও তা নিয়ে কোনো ধর্মীয় ব্যাখ্যা নেই। পাঁজিতে বৈশাখ মাসের কৃত্যগুলির মধ্যে কোথাও পয়লা বৈশাখ নববর্ষের কৃত্যের কোনো উল্লেখ নেই। আমরাই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। হালখাতাও হল তেমনই অনুষ্ঠান। পুরনো খাতার হিসাব চুকিয়ে ফেলে নতুন খাতায় খরিদ্দারের নাম উঠে যাবে এটাই তো দস্তুর। এটা ব্যাঙ্কের ইয়ারএন্ডিং নয়, এটা দোকানের খাতার নিজস্ব বছর শেষের হিসাব। কেন না নয় নয় করেও কিছু মাসকাবারি অঙ্ক বাকি থাকে যা কিছুতেই মেটে না। এদিন যদি তার কিছুটাও আদায় হয় তাহলে তো তা পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা দোকানদারের কাছে।
আর বাকিটা ক্যারি ফরোয়ার্ড সামনের বছরের খাতার পাতায়। আগেকার দিনে তো কোথাও কোথাও খরিদ্দারের বাড়িতে নাম লেখা কার্ডও পৌঁছে যেত। এখন অবশ্য হালখাতার অনুষ্ঠানেও এসেছে ভোলবদল। সেখানেও আজ ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট লুকের ছোঁয়া। আগের মতো আমপাতা আর শোলার কদম ফুল, মঙ্গলঘট দিয়ে সাজানো দোকানের দরজায় দাঁড়িয়ে হাসিমুখে দোকানির ব্যস্ততা লক্ষ্মীজ্ঞানে ক্রেতাকে আপ্যায়ণ করা আজ আর চোখে পড়ে না। অনেক বড় দোকানে আবার অন্য রকম হালখাতার আয়োজন করা হয়। সেখানে উঠতি হিরো বা হিরাইনকে এনে দোকানের মান বাড়ানো এখন এক রকমের ফ্যাশন। দোকানে উটকো জনতার হিরো দর্শনের সামলানোর জন্য কোথাও কোথাও আবার পুলিশ নামাতে হয়। সেটাই দোকানের সারা বছরের বিক্রিবাটার পথ সুগম করে।
নববর্ষের সন্ধ্যায় নতুন পোশাক পরে হালখাতা করতে যাওয়া হল উত্সবেরই অঙ্গ। হালখাতার মূল আকর্ষণ ছিল আগে রঙিন শরবত। ক্রেতার মন ও মান বজায় রেখে সার্ভ করা হত হরেক কিসিমের শরবত। শত তাগাদাতেও অনেক ক্রেতা দোকানিদের মাসকাবারির টাকা মেটাতো না। দোকানিকে ঘোল খাওয়ানো ক্রেতাকেও খাওয়ানো হত ঘোলের শরবত। ঘোল থাকলেও সম্পর্ক ঘোলাটে ছিল না। হিসাবের মতো সম্পর্কও ক্যারি ফরোয়ার্ড হয়ে যেত পরের বছর। ঘোলের সঙ্গে থাকত মিষ্টিমুখ আর থাকত এক পিস দেব-দেবী বা মহাপুরুষের ছবি দেওয়া ক্যালেন্ডার। কিন্তু এসব ছবি আর দেখা যায় না। কোল ড্রিংকের ধাক্কায় ম্রিয়মাণ ঘোলের শরবত। মিষ্টিমুখের বদলে কেক, পেস্ট্রি, পিৎজার বাঁধাছাঁদা প্যাকেট। দেবদেবীর বদলে ক্যালেন্ডারে জ্বলজ্বল করেন সিনে তারকারা। আসলে দিন বদলে হালখাতার আয়োজনেও বদল এসেছে তবে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। হালখাতা চলছে তার আপন ছন্দে, নিজস্ব নিয়মে।