ad
ad

Breaking News

Bengali Movie

অপরাধ, রহস্যভেদী ও বাংলা সিনেমা

ঠাকুমা- দিদিমারা তখন বিলুপ্ত প্রজাতি ছিলেন না, তাঁদের গল্পের হাত ধরেই ভয়, অপরাধ আর হিংসার প্রবেশ শিশুমনে।

Crime, Mystery and Bengali Movies

চিত্র: সংগৃহীত

Bangla Jago Desk: দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়: বিশ্বায়নের আগে বাঙালীর মনোলোকে ক্রাইম কী ভাবে গড়ে উঠেছিল, সেই ইতিহাস বেশ চিত্তাকর্ষক। ঠাকুমা- দিদিমারা তখন বিলুপ্ত প্রজাতি ছিলেন না, তাঁদের গল্পের হাত ধরেই ভয়, অপরাধ আর হিংসার প্রবেশ শিশুমনে। অলস দুপুর আর ভয়-ভরা রাতগুলি জীবন্ত হয়ে উঠতো ঠাকুরমার ঝুলির গল্পে। ঠাকুরমার ঝুলির রাজপুত্র, রাজকন্যা, পক্ষীরাজ ঘোড়া আর ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর মত নিরামিষ উপাখ্যানের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ভূত-পেত্নী, রাক্ষস-খোক্কস সকলেরই জোরাল উপস্থিতি ছিল আর ছিল মানানসই ছবি।

এত বছর পরেও মনে রয়ে গিয়েছে সেই সব আধপাতা জোড়া সাদা-কালো ছবি। মন্ত্রপূত শুকপাখীর গলা কাটতেই সুন্দরী রানী ভয়ঙ্করী রাক্ষসী হয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে, তার মুখে বড় বড় দাঁত, হাতে বিশাল নখ। ছবিটার তলায় লেখা- “এইবার রাক্ষসী নিপাত যাও।” বড় হয়ে মনে হয়েছে সেই লেখার মধ্যেই হয়তো ভবিষ্যতের রাজনৈতিক স্লোগানের বীজ নিহিত ছিল। রাজা-রাজার কাণ্ড ছেড়ে যদি সাধারণ মেয়ে সুখ-দুখুর গল্পে আসি, সেখানেও কিন্তু পেঁয়াজ-রসুন-লাল লঙ্কার অভাব নেই।

গরীব ও সুলক্ষণা দুখুকে কৃপা করে চাঁদের মা বুড়ি ধন, রত্ন, শাড়ী-গহনা এমনকি একটি রাজপুত্র বর পর্যন্ত পাঠিয়ে দিলেন, ওদিকে হিংসায় আকুল হয়ে তার সৎবোন সুখও মাঠে নেমে পড়ল। নানা কাণ্ডের পর সুখ বাড়ি ফিরল, হাতে তার এক বিশাল পেটরা, তার মধ্যেই নাকি তার বর আছে। পরের দিন সকালে সুখু আর ঘরের দরজা খোলে না, কেননা পেটরায় ছিল অজগর সাপ, সে সারা রাত ধরে সুখকে উদরস্থ করেছে। এই ভয়ঙ্কর গল্পের শেষ লাইনটি এখনও মনে পড়ে চেলাকাঠ মাথায় মারিয়া সুখুর মা মরিয়া গেল ৷

এত কথা বলার একটাই কারণ, আবহমান কাল ধরে বাঙালি একটা চাপা হিংসার আবহে বড় হয়ে আসছে, যেখানে ছয় রিপু নানারূপে খেলা করে। স্বাধীনতা-উত্তর সমাজে বহিরঙ্গের হিংসাও যেমন বেড়ে উঠেছিল, সাহিত্যেও হিংসার ফল্গুধারা কমল না বরং বেড়েই চলল। আমরা ঠাকুরমার ঝুলি ছেড়ে রামায়ণ-মহাভারত পড়ে মহাকাব্যিক হিংসাটা ঝালিয়ে নিলাম।

(এখনও উত্তর ভারতে অনেক হিন্দুবাড়িতে সম্পূর্ণ মহাভারত রাখা হয় না, রাখলে নাকি ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ বাধে), এইভাবে রক্তপাত, নরহত্যা আমাদের অভ্যাস হয়ে এল, আর তারই অন্যতম ফলশ্রুতি বাংলা সাহিত্যে এক একটি দিকপাল গোয়েন্দা আর সত্যান্বেষীর জনপ্রিয়তা। বাঙালী পাঠকের পছন্দের তালিকায় পঞ্চাশের দশকে ছিল ক্লাস ফাইভ-সিক্সে জয়ন্ত-মাণিক, ষাটের দশকে সেই জায়গায় এলেন দীপক চ্যাটার্জী, কলেজ পৌঁছতে পৌঁছতে স্মার্ট সুবেশ কিরীটি রায় আর তার রোমহর্ষক প্রতিদ্বন্দ্বী কালোভ্রমরের কাহিনী পড়ে মুগ্ধ হয়ে উঠল তরুণ দল, আর চাকরি পেতে পেতে মন জয় করে নিল ব্যোমকেশ বক্সী।

ট্রেনে পড়ার জন্য অনেকে পছন্দ করতেন “দস্যু মোহন”। ইদানীং কালে অবশ্য জয়ন্ত-দীপক আর মোহনকে বিশেষ দেখা যায়না, ফেলু মিত্তির বলে একজন লম্বামতন ভদ্রলোক তাঁদের জায়গা দখল করেছেন। গোয়েন্দা-কাহিনির উপর বাঙালির এই চিরাচরিত আকর্ষণ এখন সাহিত্য ছেড়ে সেলুলয়েডেও ঢুকে পড়ছে। মানুষের বই পড়ার সময় ও অভ্যাস যত কমবে বৈদ্যুতিন মাধ্যমের ওপর আকর্ষণ তত বাড়বে। একুশ শতকের আর্কিমিডিসীয় তত্ত্বের এই ফর্মুলাকে অনুসরণ করে এখন গোয়েন্দা গল্পের জয়জয়কার বাংলা সাহিত্যে এবং সিনেমায়।

পঞ্চাশ ষাটেক দশক পর্যন্ত গোয়েন্দা গল্প ছিল সাহিত্যের মাপকাঠিতে একেবারে নীচের তলায়। বাংলার একটি বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় প্রায় সিকি শতাব্দী ধরে ফেলুর কীর্তিকাহিনী প্রকাশিত হলেও সত্যজিতের ফেলু সিরিজ কিশোরপাঠ্যের তকমা থেকে মুক্ত হতে পারেনি ।

বাংলা সিনেমার আদিযুগে রহস্যগল্প নিয়ে সিনেমা করার কথা কোনও প্রযোজক পরিচালক ভাবতেই পারতেন না। সিনেমার জগতে তখন রাজত্ব করতেন বঙ্কিম-রবি-শরৎ। তাঁদের নিরাপদ ফর্মুলার বাইরে চিত্রস্রষ্টারা যেতে চাইতেন না। চল্লিশের দশকে অবশ্য অজয় কর দারুণ সাহস দেখিয়ে তৈরি করেছিলেন ‘জিঘাংসা’। যার গল্প স্পষ্টতই ‘হাউন্ড অফ বাস্কারভিল’ দ্বারা অনুপ্রাণিত। এ ছাড়া প্রেমেন্দ্র মিত্র ‘হানাবাড়ি’ জাতীয় দু-একটি ছবি করেছিলেন, যদিও কোনওটাই মনে রাখার মতো নয়। তাঁর মত অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন মানুষ কি করে এমন বালভোগ্য সিনেমা বানাতেন তা ভাবতে অবাক লাগে।

১৯৫৫ সালে মুক্তি পেল মাঝারি মাপের পরিচালক অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘দস্যু মোহন’, গোয়েন্দা গল্প না বলে যাকে থ্রিলার বলাই উচিত। ছবিটা ভাল চললেও পরিচালক বোধহয় জাতে উঠতে চেয়েছিলেন, কারণ যথেষ্ট সাফল্য সত্ত্বেও তিনি ওপথে আর ফিরলেন না, ‘গরীবের মেয়ে’, ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন’ প্রভৃতি সহজ সরল সামাজিক ছবি বানিয়ে তৃপ্ত থাকলেন।

পাঁচের দশকের শেষে আবার আসরে নেমেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, তিনি আগাথা ক্রিস্টির বিশ্ববিদিত কাহিনী অবলম্বনে বানালেন ‘চুপি চুপি আসে’। হয়তো গল্পটিকে সাহিত্যের মর্যাদা দেওয়ার আশায় একটি পত্রিকার পূজা সংখ্যায় তিনি তাঁর নিজের করা ভাষান্তরটি প্রকাশও করেছিলেন। ‘চুপি চুপি আসে’ গল্পটা কেউ মনে রাখে না, কিন্তু ছবিটা মোটামুটি চলেছিল, এখনও ছবিটি মাঝে মাঝে দূরদর্শনের পর্দায় চোখে পড়ে ৷

ষাটের দশকে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ব্যোমকেশের গল্প কিন্তু সাহিত্যের মর্যাদা পেয়ে গেল। সেসময় ব্যোমকেশের জনপ্রিয়তাও সন্দেহাতীত, কারণ শরদিন্দুবাবু একাধিকবার ব্যোমকেশের আখ্যান বন্ধ করলেও পাঠকের অনুরোধে লেখক ব্যোমকেশকে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু এখানেও ব্যোমকেশকে নিয়ে সিনেমা করার ব্যাপারে একটা অদ্ভূত অনীহা দেখা যায়।

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে পেশাদার চিত্রনাট্য রচয়িতা ছিলেন, তাঁর কাহিনীতে নাট্যরসের অভাবও থাকে না, তবুও কোনও পরিচালক, প্রযোজক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা গল্প নিয়ে সিনেমা করার কথা অনেকদিন পর্যন্ত ভাবেননি। শেষ পর্যন্ত বাংলা সিনেমার সবচেয়ে লম্বা মানুষটিকেই-শারীরিক এবং আলঙ্কারিক উভয়ার্থেই-এই দীর্ঘ পদক্ষেপটি নিতে হল, যদিও স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নয়। তাঁর সহকারিরা ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিটি বানাতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলায় গুরুকে শিষ্যদের ত্রাণ করতে এগিয়ে আসতে হয়।

উত্তমকুমারকে ব্যোমকেশ বানানোয় চরিত্রটিতে গ্ল্যামার এল। এ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালকের জাতীয় পুরষ্কার পেয়ে সত্যজিৎ রায় রীতিমত বিস্মিতই হয়েছিলেন। কারণ সিনেমায় গল্পের ফাঁক-ফোকরগুলি তাঁর চোখে ঢাকা পড়েনি। কিন্তু সত্যাজিৎ-উত্তমকুমারের যুগলবন্দীর মাধ্যমে সৃষ্টি হল বাংলা সিনেমার একটি প্রবাদপ্রতিম চরিত্র। সত্যজিৎকে আর কখনও ব্যোমকেশকে নিয়ে চিন্তা করতে দেখা যায়না, তিনি এক ধাপ এগিয়ে প্রথমে লেখক ও পরে চলচ্চিত্রকার হিসাবে ব্যোমকেশের একজন উত্তরাধিকারী সৃষ্টি করে নতুন একটি আদ্যোপান্ত গোয়েন্দা আমাদের সামনে আনলেন। আমরা পেলাম ফেলু মিত্তিরকে।

ফেলুদা বাংলা সাহিত্যে প্রথম আইকন গোয়েন্দা, যিনি স্বাধীনতার কাছাকাছি সময়ে জন্মেছেন। বাংলা সাহিত্যে কিংবদন্তী গোয়েন্দাদের পরম্পরার দিকে একটু তাকালেই বোঝা যাবে গোয়েন্দা কাহিনী তরুণ পাঠকমন কতটা আকর্ষণ করতে পারে সেসম্বন্ধে সত্যজিৎ কতটা সচেতন ছিলেন। তিনি কিশোর পাঠকদের জন্যই ফেলুদাকে সৃষ্টি করেছিলেন। যেজন্য সত্যজিৎ রায়ের ফেলুকাহিনী ঘোরতরভাবে স্ত্রীভূমিকা বর্জিত।

হেমান্দ্রকুমার রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নীহাররঞ্জন রায়ের গোয়েন্দারা সকলেই পরাধীন ভারতে জন্মেছিলেন ও কাজ করেছেন। হয়তো কিছুটা দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী মনোভাবে আচ্ছন্ন হয়ে সেকালের অনেক তরুণের মত তাঁরা সকলেই শরীরচর্চা ও ব্রহ্মচর্যে বিশ্বাসী ছিলেন। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের জয়ন্ত ও বিমল এঁদের পুরোধা। কিন্তু বাঙালি গোয়েন্দারা কেউই লন্ডনের বেকার স্ট্রীটের শার্লক হোমস নামক লম্বা গোয়েন্দাটির দীর্ঘ ছায়া থেকে মুক্ত হতে পারেননি। তবে তাঁরা সকলেই মনে প্রাণে বাঙালি গোয়েন্দা চরিত্র তৈরি করেছিলেন, যাঁরা কেউই শার্লক হোমসের মত ঈষৎ খ্যাপাটে, নেশাখোর, নারীদ্বেষী ও বেহালাবাদক ছিলেন না।

তাঁদের নেশা ছিল ঠিকই, কিন্তু সে নেশা একান্তই ছাপোষা জয়ন্তের নস্য, কিরীটির পাইপ, ব্যোমকেশের সিগারেট এবং ফেলুর চারমিনারেই সীমাবদ্ধ। শার্লক হোমসের মতোই প্রথম যুগের গোয়েন্দাদের অকৃতদার থাকা ফ্যাশন ছিল, সেই প্রথা ভাঙলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় আর নীহাররঞ্জন গুপ্ত। ব্যোমকেশ ও কিরীটি, দু’জনেই প্রেম করেছেন এবং বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন। গোয়েন্দাদের নামকরণের সময় শরদিন্দুবাবু অনুপ্রাসের মোহ ভাঙতে পারেননি, সত্যজিতের প্রদোষ মিত্র কিন্তু সাধারণ বাঙালি নাম।

তাঁর গোয়েন্দার পদবী বক্সী কেন, এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে শরদিন্দুবাবু বলেছিলেন- আমার ধারণা কায়স্থরা ব্রাহ্মণদের থেকে বেশি বুদ্ধি রাখে। সত্যজিতও কি সেই মতে বিশ্বাসী ছিলেন? একদিন যে তাঁর গোয়েন্দাকে কোনও ভবিষ্যদ্বক্তা সন্ধ্যাশশী বন্ধু বলে সম্বোধন করবে একথা তিনি নিশ্চয়ই আগে জানতেন না।

একটি বিষয়ে সত্যজিৎ কিন্তু দেশি-বিদেশি সব লেখককে টেক্কা দিয়েছেন। সব রহস্যভেদীরই একজন চামচা গোছের সহকারি থাকে। সে তুলনায় অল্পবুদ্ধি, অনেকটা যেন পাঠকসম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। সত্যজিৎ আমদানী করলেন দু-দুটি চরিত্র-খুন বা কোন গুরুগম্ভীর অপরাধের ঘনঘোর পরিবেশে নির্মল শুভ্র হাস্যরস পরিবেশনের দায়িত্ব নিলেন লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ু আর মূল সহকারি হলেন কিশোরপাঠকের প্রতিনিধি তোপসে। জটায়ুর মতো একটি হাস্যকর অথচ সিরিয়াস চরিত্র তৈরি করতে হেমেন্দ্রকুমার রায়ও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সুন্দরবাবু একজন প্রবীণ পুলিশকর্মী, একটা স্তরের বেশি তাঁকে নিয়ে তামাশা করা যায় না।

সময়ের সঙ্গে বাংলার গোয়েন্দাদের পরিচয় বদলেছে। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের জয়ন্ত বরাবর নিজেকে বলেছেন, সখের গোয়েন্দা, অর্থাৎ এই কর্মটি তাঁর পেশা নয়। ব্যোমকেশ পেশাদারী গোয়েন্দা হলেও নিজের পরিচয় দিতেন সত্যান্বেষী, কেননা তাঁর আসল উদ্দেশ্য সত্য উদ্ঘাটন। ঘটনাক্রমে তাঁর স্ত্রীর নামও সত্যবতী! কিরীটি রায় নিজেকে বলতেন রহস্যভেদী, কোনও কিছুই তিনি আবছা রাখতে চাননা। পরাশর বর্মা গোয়েন্দা কবি, তার অনুসন্ধানের মধ্যে কোথাও একটা ছন্দ আছে, তাই হয়তো তাঁর সহকারীর নাম কৃত্তিবাস, বাংলার অন্যতম আদি কবি। ফেলু কার্ড ছাপিয়ে নিজের পরিচয় দেয় প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর, সে একান্তভাবে অনুসন্ধান চালায়, কর্মই যেন তাঁর লক্ষ্য, ফল নয়।

বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরাণীতে হরবল্লভ পুলিশকে দেবীর গতিবিধির খবর দিত, সে পুলিশের গোয়েন্দা অর্থাৎ যে খবর সংগ্রহ এবং সরবরাহ করে সেই গোয়েন্দা, তাই হয়ত সত্যজিৎ নিজে ফেলুকে গোয়েন্দাই বলতেন। এভাবে বিচার করলে হয়ত থেকে সবথেকে সার্থক গোয়েন্দা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান লেখক স্টিভ লারসনের সাংবাদিক-গোয়েন্দা কার্ল ব্লমকভিস্ট।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গোয়েন্দার ভাবমূর্তিও বদলায়। ষাটের শেষে চিড়িয়াখানা নির্মাণের সময় বাঙালী পাঠক-দর্শকের কাছে ব্যোমকেশ এত জনপ্রিয় যে, তাঁর ভূমিকায় উত্তমকুমারকে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন পরিচালক। দেড় দর্শক পরে যখন তাঁকে সর্বভারতীয় দর্শকদের সামনে পেশ করেন বাসু চ্যাটার্জী, তখন স্বল্পখ্যাত মঞ্চাভিনেতা রাজিত কাপুরকে দিয়েই কাজ চলে গিয়েছিল। এর পরে কয়েক দশক ধরে চলল ফেলুদার জয়জয়কার–সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সব্যসাচী চক্রবর্ত্তী, শশী কাপুরের মতো নামীদামী অভিনেতারা ফেলু চরিত্রটিতে রূপদান করলেন।

একবিংশ শতাব্দীতে যখন পাঠক মহল ফেলুদাকেই বেশি চেনে, তখন নতুন করে ব্যোমকেশকে পরিবেশন করলেন অঞ্জন দত্ত। নবাগত অভিনেতা আবীর চ্যাটার্জিকে দিয়ে ব্যোমকেশের যাত্রা শুরু হল। ব্যোমকেশ ফিরে এল ছোট পর্দায় সব্যসাচীপুত্র গৌরবের চেহারা নিয়ে, ঋতুপর্ণ ঘোষের মতো পরিচালকও তার হাতছানি এড়াতে পারলেন না। অঞ্জনের ব্যোমকেশ বড় পর্দায় বেশ জমিয়ে বসেছিলেন, হঠাৎ ব্যোমকেশরূপী আবীর হয়ে গেলেন ফেলুদা! একেই কি বলে সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন ? সাম্প্রতিক এক পুজোয় স্ক্রিন দখলের লড়াইতে নামলেন এক আবীর দুই চরিত্রে-ফেলু ও ব্যোমকেশ। দুই গোয়েন্দা কেউ কাউকে জমি ছাড়েননি, যদিও ব্যোমকেশ বোধহয় একটু হলেও এগিয়ে ছিলেন।

ব্যোমকেশকে সারা দেশের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন দিবাকর ব্যানার্জী, কিন্তু এক গল্পে অনেক কিছু মেশাতে গিয়ে পরিচালক খেই হারিয়ে ফেললেন এবং নতুন ব্যোমকেশ সুশান্ত সিং রাজপুতও মনে দাগ কাটতে পারলেন না। এরই মধ্যে অরিন্দম শীলের হাত ধরে এসে গেলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের শবর দাশগুপ্ত। শ্বাশত চট্টোপাধ্যায় অভিনীত শবর সকলের চেয়ে আলাদা, কেননা সে পুলিশের বড় অফিসার, অন্যদের মত তাঁকে পুলিশের সহায়তা প্রার্থনা করতে হয়না। এই কারণে তার আত্মপ্রত্যয় ও শরীরী ভাষা একেবারে আলাদা।

এই মুহূর্তে বাংলা সিনেমায় গোয়েন্দাদের নিয়ে পরিচালক, প্রযোজক, দর্শককুল সকলে সুখেই আছেন, সমাজেও অপরাধ পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। মাঝে মাঝে ভাবি সিল্কের কিমোনো আর ঘাসের চপ্পল পরা স্টাইলিশ কিরীটি রায় আর হারকুল পয়রোর ভঙ্গিতে অনুসন্ধানকারী পরাশর বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে রয়েছেন কেন? নতুন প্রজন্মের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় করাতে কেউ কি চেষ্টা করবেন?