নিজস্ব চিত্র
Bangla Jago Desk: অসীম কুমার মিত্র: হাওড়া জেলার জগৎবল্লভপুর থানার পাতিহাল গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন নিজবালিয়া গ্রাম। পূর্বে এই গ্রামটি ছিল প্রাচীন বালিয়া পরগনার অন্তর্গত। ‘বালিয়া’ শব্দযুক্ত এই গ্রাম নামের উৎপত্তি সম্ভবত মাটির গঠন অনুযায়ী। নিজবালিয়া মৌজার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বহু প্রাচীন নিমকাঠে নির্মিত দেবী সিংহবাহিনী মূর্তি এবং আটচালা মন্দির জেলার মধ্যে অন্যতম দর্শনীয় স্থান। এই মন্দিরের সঙ্গে লুকিয়ে আছে অনেক মাহাত্ম্য। তবে এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে তা আজও অজানা।
নিজবালিয়া গ্রামের দেবী সিংহবাহিনীকে ঘিরে রয়েছে নানা অলৌকিক দৈবীমহিমা সম্পর্কিত বহু জনশ্রুতি। সিংহবাহিনী মন্দিরের সামনে রয়েছে উন্মুক্ত প্রাঙ্গন। এই প্রাঙ্গন থেকেই উঠে গেছে মার্বেল বাঁধানো সিঁড়ি। কয়েক ধাপ ওঠার পরই মন্দিরের সিংহদ্বার। দরজার সামনে দাঁড়িয়েই দৃষ্টি থমকে যাবে-মাটিতে প্রোথিত গাঢ় লাল রঙের যূপকাষ্ট।
ছেদ স্থানটি সিমেন্টের প্লেটে আচ্ছাদিত। বলির সময় প্লেটগুলি সরিয়ে নেওয়া হয়। দরজা উন্মুক্ত থাকলে এখান থেকে সরলরেখায় দেবীমূর্তি দর্শন হয়। এরপর নাটমণ্ডপ। মণ্ডপটি দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে ২০’×১২’ । মণ্ডপ পেরিয়ে প্রায় দশ হাত বাঁধানো খোলা চত্বর। তারপরই দেবীর আটচালা মন্দির। মন্দিরটি খুবই দৃষ্টিনন্দন।
মন্দির সংযুক্ত চারচালা জগমোহনযুক্ত মন্দির। মূল মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত জগমোহনটি ভক্তদের বসার জায়গা। স্থানীয় মানুষ এই স্থানটিকে জোড়-বাংলো বলেন। ভক্তরা এখান থেকেই পূজাসামগ্রী মন্দিরের ভেতরে এগিয়ে দেন। দেবীদর্শন ও পূজাপাঠ নিরীক্ষণ করেন। জগমোহন থেকে বেরিয়ে গর্ভগৃহ। তার ঈষৎ উত্তরে দেবীর রন্ধনশালা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিত্য সেবার যাবতীয় প্রসাদ, নৈবেদ্য, পাকাভোগ এবং শীতলাদি সব সেখানেই প্রস্তুত হয়।
দেবী দক্ষিণাস্যা অষ্টভূজা সিংহবাহিনী। সিংহবাহিনী আদ্যাশক্তি মহামায়া দেবী ভগবতীর এক রূপ। দেবী কাঞ্চনবর্ণা। উচ্চতা প্রায় দেড় মিটার। দেবীর ডানদিকের হস্তসমূহে ধৃত অসি, বাণ ও পাশ, বামদিকের হস্তসমূহে ঢাল, ধনুর্বাণ এবং শঙ্খ। অবশিষ্ট দক্ষিণ ও বাম হাত দুটিতে বর ও অভয়মুদ্রা। তাঁর পায়ের নীচে বাহন এক শ্বেতসিংহ; যার পিঠের উপর দাঁড়িয়ে তিনি অলৌকিক হাসি হাসছেন।
পূর্ব-পশ্চিমে প্রসারিত মর্মরগঠিত সিংহাসনে দেবী অধিষ্ঠিতা। সিংহাসনের বহির্ভাগে নীচ থেকে ওপর পর্যন্ত দু’পাশে থাকে থাকে সাজানো বারোটি দর্শনীয় কাচের শিবমূর্তি। আর ভেতরের অংশে দেবীর দুই পাশে নক্শা করা দশমহাবিদ্যার রূপ। তাঁর মাথার উপরে উপবিষ্ট হরনাথ, তাঁর পাশে বাহন, হৃষ্টপুষ্ট একটি ষাঁড়। দেবী দারু নির্মিতা, নিমকাঠের। কে বা কারা বা কখন এই জ্যোর্তিময়ী, অপরূপা ও অনুপম দেবীমূর্তি নির্মাণ করেছিলেন তার সঠিক হদিস আজও পাওয়া যায় নি।
দেবী মূর্তি যেহেতু নিমকাঠের, সে কারণে এই পরগনার অন্তর্গত কোনো বাড়িতে আজও নিমকাঠ পোড়ানো হয় না। গবেষকদের অনুমান অনুযায়ী এই মূর্তি যদি ষোড়শ শতকের হয়, তাহলে বিগত পাঁচশো বছর ধরে সেই আদি মূর্তি আজ অবধি অবিকৃত, অসাধারণ সৌন্দর্যে অটুট। দশ-বারো বছর ছাড়া অঙ্গরাগ করা হয় মাত্র।
লোক গবেষক শিবেন্দু মান্নার মতে দেবী সিংহবাহিনী আদতে ছিলেন স্থানীয় এক ভূস্বামী বংশের কুলদেবী। তিনি ১৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমানের রাজা কৃষ্ণরাম রায়ের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। কৃষ্ণরাম প্রচুর ভূসম্পত্তি দেবী সিংহবাহিনীর নামে দান করেছিলেন। বালিয়া পরগনায় দশভূজার পূজা নিষিদ্ধ হলেও শরৎকালের পুজোটি কিন্তু বাদ যায় না। এই অষ্টভূজার মন্দিরেই সেটি অনুষ্ঠিত হয় এবং একেবারে পূজার নির্ঘন্ট ধরে। নবমীতে বলিদানও হয়।
তবে এখানে দুর্গাপুজো না হলেও অন্যান্য দেব-দেবীর পুজোয় বাধা নেই। প্রথা হল, যাঁর বাড়িতে যে পুজোই হোক, সর্বাগ্রে সিংহবাহিনীকে পূজা দিয়ে সেখানে পূজা করতে হবে। কারণ, ইনিই এই পরগনার একচ্ছত্র অধীশ্বরী। এখানে সমস্ত দেব-দেবীর মূর্তির বিসর্জন হয় দেবীর নিজস্ব দিঘিতে।
সিংহবাহিনীর নিত্যসেবার পদ্ধতি হল, সকাল দশটায় পূজা। বারোটায় ভোগ। ভোগে মাছ অবশ্যই চাই। তারপর দরজা বন্ধ। সন্ধ্যায় শীতল এবং আরতি। পূজার জন্য ছ’জন পূজারী আছেন। এছাড়া পুজার ফুলের জন্য মালি, মন্দির ধোয়া-মোছার লোক, রান্নার জোগাড়ে, পাচক, আরতির সময় বাজাবার জন্য ঢুলি সব নির্দিষ্ট আছে। এঁরা প্রতিদিন প্রসাদ পান এবং মাসিক পারিশ্রমিকও পান। দেবীর স্টেট থেকেই এসব চলে। সেবাইত কমিটি আছে, তাঁরাই এসব দেখাশোনা করেন।
দেবীর মূল উৎসব হয় বৈশাখের সীতানবমী তিথিতে। শ্রীরামনবমীর ঠিক একমাস পরে। গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকায় এর উল্লেখ আছে। এই পূজার বৈশিষ্ট্য হল, পূজার (সীতানবমীর দিন ধরে) তিনদিন আগে থেকে চণ্ডীপাঠ হয়। বিভিন্ন এলাকা থেকে কুড়িজন পণ্ডিত আসেন চন্ডীপাঠের জন্য। মূল মন্দিরে দু’জন, জগমোহনে (জোড়বাংলো) দু’জন, নাটমণ্ডপে দু’জন এবং বাঁধানো চত্বরে প্যান্ডেলের নীচে চোদ্দজন সমবেত ভাবে স্তোত্রপাঠ করেন।
সাথে হোমযজ্ঞও হয়। পাঁচ কিলো ঘি-এর হোমে চার কুইন্টাল বেলকাঠ লাগে। এছাড়া মায়ের পূজা-আরতি তো আছেই। সন্ধ্যায় একটি আনন্দানুষ্ঠান – বাজি পোড়ানো। দেবীর মন্দিরের পশ্চিম দিকে যে দিঘি আছে তার পাড়েই এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
পরের দিনের অনুষ্ঠান হল অন্নকূট মহোৎসব। জানা যায়, ১৩৪৭ সালের আগে এই বালিয়া গ্রামগুলি একবার মহামারী ও দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। বহু মানুষের অকালমৃত্যু ঘটে – এলাকার মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। ইতিমধ্যে গ্রামের কয়েকজন প্রবীণ মানুষ কাশীতে বিশ্বনাথ দর্শনে যান।
তাঁরা সেখানে অন্নপূর্ণার অন্নকূট মহোৎসব দর্শন করেন এবং ফিরে এসেই গ্রামগুলির সহযোগিতায় সিংহবাহিনীর অন্নকূট মহোৎসবের সূচনা করেন। মূলত বালিয়া পরগনার অনুষ্ঠান হলেও পরবর্তীকালে এটি দূর-দূরান্তের মানুষের উৎসবে পরিণত হয়েছে।
অন্নকূটের দিন সকাল থেকেই চলে পূজা, আরাধনা, চন্ডীপাঠ ইত্যাদি। দুপুরে অন্নকূট উৎসবের ভোগ প্রস্তুত হয়। প্রায় তিরিশজন লোক রসুই করেন এবং মালসায় ভোগ সাজান কমপক্ষে পঁচিশজন। নাটমণ্ডপে ভোগ রাখা হয় মেঝের উপর। নিয়ম হল, নতুন খেজুর পাতার চাটাই কিনে সেগুলিকে পরিপাটি করে ধুয়ে তার ওপর অন্নভোগ রাখা হয়। অন্নভোগের পাশাপশি থাকে খিচুড়ি, সাতরকম ভাজা এবং আরো নানাবিধ ব্যঞ্জন- এঁচড়, পটল, ফুলকপি, শুক্তো, আমের চাটনি ইত্যাদি।
এছাড়া ফলমূলাদি, দধি, সন্দেশ, ক্ষীর, পায়েস ও মুনুই ইত্যাদি। এই সমস্ত ভোগই রাখার নিয়ম মাটির পাত্রে। ভোগ নিবেদনের পদ্ধতিটিও বেশ অভিনব। নাটমণ্ডপে মূল ভোগ (অন্ন) চূড় করে রাখা হয় – দেবীর জিহ্বাসমান, যাতে করে গর্ভগৃহ থেকে তিনি সরাসরি দৃষ্টি দিতে পারেন। এবার মন্ডপের সিলিং-এ একটি ঘি-ভর্তি স্টিলের পাত্র ঝোলানো থাকে। তার তলায় ছোট ছিদ্র, সেখানে একখন্ড কুশ ঢোকানো থাকে। ওই ছিদ্র দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় সেই ঘি ভোগে পড়তে থাকে। বর্তমানে তার উপরে বৈদ্যুতিক আলোকরশ্মি ফেলে নয়নাভিরাম করা হয়েছে।
অন্নকূট উৎসবের অঙ্গীভূত আর একটি অনুষ্ঠান হল ‘মঙ্গলঘট প্রদক্ষিণ’। ওইদিন বিকেলে ঢাক-ঢোল সানাই-এর শব্দে মন্দির প্রাঙ্গণ ভরে উঠতেই শুরু হয় প্রদক্ষিণ। দেবী ঘট মাথায় নিয়ে নানা রঙের শাড়ি পরিহিতা কিশোরীর দল শঙ্খ ও উলুধ্বনি দিতে দিতে আগে আগে যান। তাঁদের পেছনেই থাকেন থালার ওপর পত্রপুষ্প শোভিত ঘট মাথায় নিয়ে গ্রামের কোনো পুরুষ।
[আরও পড়ুন: ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় বড় সিদ্ধান্ত আইটি সংস্থা গুলির]
তাঁদের পিছনে অগণিত নারী-পুরুষের মিছিল। গ্রাম প্রদক্ষিণ শেষে ঘট আসে মন্দিরে। এরপর দেবীর দর্শন এবং প্রসাদ বিতরণ –‘অন্নকূট’। মালসায় সাড়ে সাত হাজার এবং ঠোঙ্গায় সাড়ে বারো হাজার অর্থাৎ প্রায় কুড়ি হাজারের প্রসাদের ব্যবস্থা। ছোট খাটো মেলা বসে এখানে। এরপর সপ্তাহব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাত্রা, নাটক, গান, নাচ, নৃত্যনাট্য প্রভৃতি পরিবেশিত হয়।
সাড়া জাগানো উৎসব। যেহেতু শারদীয়ায় এখানে সেরকম কোনো উৎসব হয় না, সেজন্য দেবী সিংহবাহিনীর পূজা ও অন্নকূট উৎসবই হল এখানকার জাতীয় উৎসব।
কিভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে নিজবালিয়ার দূরত্ব তেত্রিশ কিলোমিটার। হাওড়া বাসস্ট্যান্ড বা ধর্মতলা সিটিসি বাস স্ট্যান্ড থেকে মুন্সিরহাট বাসে উঠে পাতিহালে নেমে সেখান থেকে রিক্সাভ্যান বা অটো বা টোটোয় যাওয়া যায়।
এছাড়া হাওড়া-খান্দারঘাট মিনিবাসে চেপে সরাসরি যাওয়া যায়। হাওড়া-আমতা ট্রেনপথে পাতিহাল স্টেশনে নেমে অথবা হাওড়া-খড়গপুর ট্রেনে উঠে সাঁকরাইল স্টেশনে নেমে সেখান থেকে মুন্সীরহাট রুটের ট্রেকার ধরে বেলেবাজার (পঞ্চবটী) স্টপেজে নেমে নিজবালিয়া গ্রামে ঢুকে সামান্য হাঁটা পথ পেরিয়ে সিংহবাহিনী মন্দিরে আসা যায়।