ad
ad

Breaking News

Mahishadal

মুঘল আমলে তৈরি মহিষাদল রাজবাড়ি, জানেন কি অজানা ইতিহাস?

বাংলার ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে দেখা যায়, একটা সময়, যেমন প্রতাপশালী রাজা ছিল, তেমন বহু সামন্তরাজাও ছিলেন।

Mahishadal Palace built during the Mughal period, do you know the unknown history

Bangla Jago Desk: বাংলার ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে দেখা যায়, একটা সময়, যেমন প্রতাপশালী রাজা ছিল, তেমন বহু সামন্তরাজাও ছিলেন। অবিভক্ত মেদিনীপুরে এমন অনেক সামন্ত রাজার ইতিহাস মেলে। একটা সময় এদের হাতেই ছিল আঞ্চলিক প্রভাব ও প্রতিপত্তি। এরা দেশের শাসনকর্তাদের নামমাত্র অধীন ছিল। বরং জমিদারি বা সামন্তভূমে অনেকটাই স্বাধীনতা ভোগ করতো। পাইক বরকন্দাজ, লাঠিয়াল নিয়ে নিজেদের সৈন্যবাহিনীও পোষণ করা হত। সারা দেশটায় অনেকটা ছোট ছোট দ্বীপের মতো রাজ্যে বিভক্ত। একটি খণ্ডরাজ্যের সঙ্গে, অন্য রাজ্যের যোগাযোগ খুব একটা সুখকর ছিল না।

ফলে কেন্দ্রীয় শাসনকর্তার শাসনব্যবস্থা পৌঁছত না প্রত্যেন্ত অঞ্চলে। ফলে, স্থানীয় সামন্ত জমিদারেরা মগের মুলুকের মতো শাসন চলত। এমনই একটি অঞ্চল ছিল অধুনা পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল। মহিষাদল প্রচীন ইতিহাস দেখলে বোঝা যায়, সাধারণ মানুষের ইতিহাস, লৌকিক ইতিহাস এবং রাজবংশের ইতিহাস এক নয়। সমগ্র ইতিহাসের ক্ষুদ্র একটা অংশ মাত্র। তবু যেটুকু ইতিহাস সংক্ষিপ্ত ভাবে তুলে ধরা যায়, তারই চেষ্টা করা হচ্ছে।

ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুর, নারায়ণগড়, নাড়াজোল, ময়না, তমলুক, বগড়ী, চন্দ্রকোণা, ঘাটাল প্রভৃতি অঞ্চলে বড় বড় জমিদার-রাজা ছিল। এই সব জমিদার রাজাদের মধ্যে অন্যতম মহিষাদল অন্যতম। প্রায় ৯০০ স্ক্যোয়ার কিলোমিটার জুড়ে একটা সময় মহিষাদল রাজ্য ছড়ানো ছিল।

তবে মহিষাদল রাজবংশের গোড়ার ইতিহাস খুঁজতে গেলে অনেকটাই অন্ধকারে প্রবেশ করতে হয়। কারণ সেই পর্ব অনেকটাই জনশ্রুতি নির্ভর, এর কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি বা যুক্তি নেই। অধিকাংশ এই সামন্ত রাজাদের ও রাজত্বের সূচনার কাহিনি এক। ইতিহাসের যুগসন্ধিক্ষণে, মূলত পাঠান মুঘল যুগে বাংলার বাইরে থেকে বহু যোদ্ধা, ব্যবসায়ীর বেশে ভাগ্যান্বেষণে এসেছিলেন প্রাচীন বঙ্গদেশে। তারপর কেউ জমিদারি পেয়ে, কেউবা খিলাৎ পেয়ে ভূস্বামী হয়ে উঠেছিলেন। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, সেই সময় অনেকেই বাঙালি দেওয়ান, ম্যানেজার বা আমলাদের সাহায্য নিয়েছিলেন।
কিংবদন্তী রয়েছে,

উত্তরপ্রদেশীয় সামবেদীয় ব্রাহ্মণবংশের কোনও এক জনার্দন উপাধ্যায় মহিষাদল রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি কোনও এক সময়, পাঠান মুঘলের সংঘর্ষ যখন চলছিল, সেই সময়ই ব্যবসা বাণিদ্যের জন্য এদেশে আসেন।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, বর্ধমান রাজবংশের ইতিহাসেও এমন কাহিনী চালু রয়েছে। কেউ কেউ দাবি করেন, জনার্দন মুঘলসেনাদের একজন কর্মচারী ছিলেন পরে তিনি ভূস্বামী হয়ে বাংলায় থেকে গিয়েছেন। কাহিনি যাই হোক, বর্ধমানসহ অন্যান্য রাজবাড়ির রাজকাহিনি সঙ্গে একই গল্প মিলে যায়। জনার্দন যে সময় বাংলায় আসেন, সেই সময় স্থানীয় জমিদার ছিলেন কল্যাণ রায়চৌধুরী। কথিত রয়েছে, কৌশলে কল্যাণের জমিদারি গ্রাস করেছিলেন জনার্দন। আসলে কল্যাণ বকেয়া খাজনা দিতে না পারায় জনার্দনের শরণাপন্ন হন। শেষে তাঁকে পুরো জমিদারি জনার্দনের হাতে তুলে দিতে হয় সর্বস্বান্ত হয়ে। এর থেকে বেশি কল্যাণ চৌধুরী সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। স্থানীয় ইতিহাস বলছে,

মুঘল আমলে জমিদারি পেয়েছিলেন জনার্দন। কিন্তু কীভাবে পেয়েছিলেন, সেই সম্পর্কে সুষ্পষ্ট কোনও তথ্য মেলে না। রাজবাড়ির অস্ত্রাগারে দুটি মূল্যবান নিদর্শন রয়েছে। বৈরাম খাঁর নামাঙ্কিত একটি তরবারি এবং চিত্রসম্বলিত কবি ফিরদৌসির শাহনামা গ্রন্থের কপি।

জানা যায়, এই তরবারি জনার্দন মুঘল শাসকের কাছ থেকে উপহার স্বরূপ পেয়েছিলেন।
জনার্দনের মৃত্যুর পর তাঁর এক পুত্র দুর্যোধন বা দুর্জন উপাধ্যায় কয়েক বছর রাজত্ব করেন। দুর্যোধনের পর রামশরণ উপাধ্যায়, রাজারাম উপাধ্যায়, শুকলাল উপাধ্যায়, আনন্দলাল উপাধ্যায় ও তাঁর সহধর্মিনী রানী জানকি রাজত্ব করেছিলেন। ১৭৭০ সালে রাজা আনন্দলালের মৃত্যুর পর রানী জানকী রাজ্যের দায়িত্বভার নিজের হাতে তুলে নেন। এই কাহিনি মেলে তমলুকের এক অখ্যাত চড়ক গাজনের সন্ন্যাসীর লেখা তর্জাগানে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ১৮০৪ সালে রানী জানকীর মৃত্যু হয়। তারপরেই রাজ্যে নানা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মূলত সমস্যা শুরু হয়েছিল, উত্তরাধিকার নিয়ে। পৌষ্যপুত্রের দাবি নিয়ে, রাজ্যের অধিকার নিয়ে বিবাদ ও মামলা বহুদিন ধরে চলতে থাকে। রানী জানকীর মৃত্যুর পর গুরুপ্রদাস গর্গ, ভবানীপ্রসাদ, কালিকাপ্রসাদ গর্গ কিছুদিন রাজত্ব করেন।

গুরুপ্রসাদের মৃত্যুর পর রানী মন্থরাদেবী তাঁর পুত্র জগন্নাথ গর্গকে রাজ্যের আসল উত্তরাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেন। মতিলাল পাঁড়ে এই দাবির বিরুদ্ধে পৌষ্যপুত্রদের অধিকার নিয়ে মামলা দায়ের করেন। মামলা গড়িয়েছিল, লন্ডনে প্রিভি কাউন্সিল পর্যন্ত। অবশেষে জগন্নাথ গর্গের মৃত্যুর পর, তাঁর স্ত্রী ইন্দ্রাণীদেবী রাজ্যভার নিজের হাতে তুলে নেন। তাঁর পুত্র রামনাথ গর্গ সাবালক হওয়ার পর রাজা হন। রামনাথের সহধর্মিনী রানী বিমলা দেবী নিজের পতির সঙ্গে সহমরণ বরণ করেছিলেন। রামনাথ ও বিমলা দেবীর পর মহিষাদলে আরও অনেক রাজা এখানে রাজত্ব করেন। মহিষাদলের রামবাগ গ্রামে রামজীউর মন্দির রয়েছে।

১৭১০ শকাব্দে রানী জানকীদেবী এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিহাসবিদদের মত, রামচন্দ্রের পুজো উত্তরপ্রদেশে প্রচলিত বাংলাদেশে নয়, রামায়নের কাহিনী বাংলাদেশে জনপ্রিয়, রামায়নের কাহিনিও বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে, কিন্তু রাম, সীতা, লক্ষ্মন, হনুমান বাংলায় দেবতা হিসেবে পূজিত হতে না। অথচ রামজীউর মন্দিরে এঁরা সকলেই প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন।

উড়িষ্যার স্মৃতিরূপে এঁদের সঙ্গে রয়েছেন জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রাও। পাশাপাশি রয়েছে শালগ্রাম শীলা। মহিষাদলে রামজীউর রথ বিখ্যাত। কথিত রয়েছে, রামজীউর পুজোয় ও দেবসেবায় কোনও ত্রুটি হলে দেবতারা ক্ষুব্ধ হন। স্বপ্নে ভয়ও দেখান। এমনকি হনুমানজি প্রহারও করেন।
রামজীউর মন্দিরের আগে রানী জানকীদেবী ১৭০০ শকাব্দে গোপালজীউর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মহাসমারোহে গোপালজীউর পুজো ও সেবা করা হত। প্রধানত রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় । এই অঞ্চলে বাসুলীদেবী নামে এক বিখ্যাত দেবীও আছেন। বাসুলীদেবী সম্পর্কে যে কথা প্রচলিত রয়েছে, তা হল,

দেবী নিজেকে ব্রাহ্মণকন্যা বলে পরিচয় দিয়ে ধীবর গৃহে অবস্থান করেন এবং তাঁকে পিতা বলে সম্বোধন করেন। দেবীর অবস্থানের পর ধীবরের অবস্থাও দিন দিন পরিবর্তন হতে থাকে। দেশাধিপতি এই সংবাদ পেয়ে ষোড়শী ব্রাহ্মণকন্যাকে রাজপুরীতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন।

দূতেরা যখন ধীবরগৃহে উপস্থিত হয়ে রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাওয়ার কথা প্রকাশ করেন, তখন দেবী ব্রাহ্মণ কন্যার রূপ ছেড়ে পাথরখণ্ডের রূপ নেন। রাজদূতেরা, পুরো ঘটনা রাজাকে জানায়। এদিকে ধীবর দম্পতি পাথরটিকে নদীর জলে অর্পণ করেন। পরে কোনও এক সময়, এক ব্রাহ্মণ স্বপ্নাদেশ পেয়ে নদীর পাড় থেকে ওই শিলাখণ্ড উদ্ধার করে নিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে দেবীর নীম হয় বাসুলীদেবী। চণ্ডীদাসের কাব্যে বাসুলী বিশেষ জায়গা করে রয়েছেন। বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসেও বাসুলীর দেবীর গুরুত্ব অপরিসীম। বাঁকুড়া ছাতনা অঞ্চলে বাসুলী পুজোর প্রচলন রয়েছে। মহিষাদল থেকে কিছু দূরে দামোদর নদীর পাড়েই রয়েছে মিরপুর গ্রাম। কেউ এই গ্রামকে বলে থাকেন ফিরিঙ্গি গ্রাম কেউবা বলেন গেঁওখালির ফিরিঙ্গিপাড়া। বর্তমানে এই গ্রামের গুরুত্ব না থাকলেও, রয়েছে এক ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। যদিও বর্তমানে গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দা নিজেদের পর্তুগিজের বংশধর ভাবলেও, হাবে ভাবে, চেহারায় পুরোপুরি বাঙালি।

বর্গি হানা থেকে রক্ষা পেতে মহিষাদলের রাজারা পর্তুগিজ গোলন্দাজদের নিয়ে এসেছিলেন। অর্থাৎ সময়টা অষ্টাদশ শতাব্দী। তার অবশ্য অনেক আগে থেকেই বাংলার ভুঁইয়ারা পর্তুগিজদের আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশে ষোড়শ শতাব্দী থেকে পর্তুগিজরা নিয়মিত আনাগোনা শুরু করে।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে পর্তুগিজ গোলন্দাজদের নিয়ে এসে মিরপুরে নিষ্কর জমি দেওয়া হয়েছিল। মেদিনীপুরের অন্যান্য গ্রামের মতোই মিরপুর এখনও একটি সাধারণ গ্রাম, ধনী জমিদার বা বণিকদের গ্রাম নয়। পর্তুগিজদের স্মৃতি বলতে রয়েছে কেবল দুটি চার্চ। গ্রামের ইতিহাস হল, রাজা আনন্দলাল উপাধ্যায় বা তাঁর স্ত্রী জানকী দেবী পর্তুগিজ গোলন্দাজদের এখানে এনে নিষ্কর জমি দান করে বসতি তৈরি করেছিলেন। কোথা থেকে পর্তুগিজদের এখানে আনা হয়েছিল, তা বর্তমানের বাসিন্দারা জানেন না। কেউ কেউ মনে করেন গোয়া থেকে আনা হয়েছিল। কিন্তু গোয়ানিজ সংস্কৃতির লেশ মাত্র নেই এখানে। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, মিরপুরের খ্রিস্টানদের সকলেরই যে পূর্বপুরুষ পর্তুগিজ তা নয়। কারণ বহু গ্রামবাসি পরে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। আজ মেদিনীপুরের এই ইতিহাসকে চাক্ষুষ করতে গেলে, বাস্তবিক দৃষ্টিতে অনেক কিছুই ধরা পড়ে না। কিছু স্থাপত্য রয়েছে বটে, আবার বহু স্থাপনা হারিয়ে গিয়েছে দামোদরের অতলে। স্রেফ রয়েছে গিয়েছে সাদা পাতায় কালো হরফে।