ad
ad

Breaking News

History of Bengali puppet dance

চেনা বাংলার অজানা কথায়: বাংলার পুতুল নাচের ইতিকথা

রাস্তার ধারে মিলিয়ে যায় নগরায়নের ছাপ। ক্রমে। আরও, আরও... কোল পাতে মেঠো পথ। বাঁকের কোণে মজা নদীর পাড়ে বাঁধা নৌকাটা হেলেদুলে শেষ পাড়ানির প্রতীক্ষায়।

History of Bengali puppet dance

Bangla Jago Desk: রাস্তার ধারে মিলিয়ে যায় নগরায়নের ছাপ। ক্রমে। আরও, আরও… কোল পাতে মেঠো পথ। বাঁকের কোণে মজা নদীর পাড়ে বাঁধা নৌকাটা হেলেদুলে শেষ পাড়ানির প্রতীক্ষায়। স্তব্ধ দুপুর। সূর্য ডুবলে মেলার মাঠে বিলি কাটবে আলো। ওরা নাচবে সুতোর ইশারায়। পরনে রঙিন কাপড়। মাথায় কারও পাগড়ি, কারও মুকুট, কারও গলায় রঙিন মালা, রঙিন ধুতি। উপচে পড়া ভিড়ে করতালি… ঠাঁয় চোখের দৃষ্টি। নাচে সুন্দরী রঙ্গে ভুলাইলা দেবো ত্রিপুরারী’। মাটির পুতুল। রকমারি, বাহারি। সুপ্রাচীন কাল থেকেই বাংলার ঘরে ঘরে মাটির পুতুল তৈরির চল নতুন কিছু নয়। শৈশবের ইকির-মিকির, বিয়ে বিয়ে খেলার গায়ে ভরা থাকত পুতুলের গন্ধ। মায়ের হাতের পুতুল। সোহাগ চাঁদ বদনীর কপালে চিকচিকে তারা। পায়ে নুপূর। বিয়ের সানাই। গালে শরমের রং। শৈশব নেই। আছে পুতুলটা। ‘নাচো তো দেখি’… পুতুল তৈরি ভাবাটা যত না সহজ, কাজে ততটাই কঠিন। ‘লবঙ্গলতিকার দেশে’ পাড়ি দেওয়া কী খুব হেলাফেলার? পেশাদারিত্ব, হাতের মাধুর্য্য, মনের নান্দনিকতা… এই ত্রয়ীর মিশেল না থাকলে ওরা মঞ্চ মাতাতো কী? মাটির পুতুল, কাঠের পুতুল, দেবদেবী, মহাপুরুষ, লোক-চরিত্র, হাতি-ঘোড়া। ওরা থাকে পাশাপাশি… আহারে… ‘এ এক মজার খেলা চলে রাত্রিদিন’…

পুতুলের প্রকারভেদ

উপকরণের রকমফেরে পুতুলেরও ভাগের শেষ নেই। মাটির পুতুল, কাপড়ের পুতুল, কাঠের পুতুল, পাটের পুতুল, তালপাতার পুতুল, গালার পুতুল, ধাতুর পুতুল, কাগজের পুতুল ও শোলার পুতুল — এই হলো ন’ভাগ। সঙ্গে জুড়ে গেছে কাঁঠালিয়ার পুতুল, রানি পুতুল, ট্যাপা পুতুল। পরে শিবের মুখোশও।

[আরও পড়ুনঃ শতবর্ষের আলোকে সুচিত্রা মিত্র

পুতুল ও বঙ্গজীবন

বাংলার লোকসংস্কৃতির এক স্তম্ভ এই পুতুল, পুতুলনাচ। জীবন, জীবিকা, মনোরঞ্জন যার সমার্থক। ভাত জোটে নিরন্নের। বাংলার শ্রমজীবী সত্ত্বার সঙ্গে জাপটে-লেপটে পুতুল। উঁকি দেয় ইতিহাস। আদিবাসী দেবতাদের উদ্দেশ্যে যেমন পুতুল গড়া হয়েছে, তেমনই মনসা কিম্বা শিবের উদ্দেশ্যেও তৈরি হয়েছে পুতুল। বাংলার লৌকিক ধর্মের সঙ্গে গেঁথে প্রাচীন এই শিল্প। “ক্ষণে হাসে, ক্ষণে গায়, ক্ষণে আঁখি ঘুরায়”…

পুতুলের রকমফের

• দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মজিলপুরে মাটির পুতুলের চল বেশি
• বিখ্যাত পাঁচুবাবুর পুতুল, জনপ্রিয় দুর্গা-শিবের অবয়ব
• কাঠের পুতুল সাধারণত মমি আকৃতির, বিখ্যাত নতুনগ্রামে
• পাটের জল পচিয়ে হয় তন্তুর পুতুল, তালপাতায় তালপাতার পুতুল

অঞ্চলবিশেষও বৈচিত্র্য আছে পুতুলের। যার অন্যতম গালার পুতুল। উঁইয়ের ঢিবি থেকে মাটি এনে তিন দিন জলে ভিজিয়ে রাখতে হয়। তাতেই কাঁকর বেরিয়ে গেঁজিয়ে ওঠে তা। এরপর পুতুল গড়ে তা প্রথমে ছায়ায় ও পরে রোদে শুকোনা হয়। প্রয়োজন পড়ে ঘুঁটের। এরপর রং। গালার সুতো দিয়ে হয় নকশা।
রানি পুতুল আবার বিখ্যাত হাওড়ায়। বিশেষত জগতবল্লভপুরে। পরনে ঘাগরা। পরতে পরতে ব্রিটিশ আমলের ছাপ। রানি ভিক্টোরিয়ার মুখই শেষ কথা। তিনিই রানি। পা থাকে না এই পুতুলের। কোঁকড়ানো চুল। ব্যবহার করা হয় অভ্র। রং গোলাপি।

অঞ্চলভেদে পুতুল

• বাঁকুড়ার টেরাকোটা-টুসু পুতুল, বিষ্ণুপুরের হিঙ্গুল পুতুল
• মেদিনীপুরের জো পুতুল, দীপলক্ষ্মী পুতুল
• কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণি, উ: চব্বিশ পরগনার ঘাড়নাড়া পুতুল
• উত্তর দিনাজপুরের ষষ্ঠী পুতুল, মুর্শিদাবাদের কাঁঠালিয়ার
• বর্ধমানের কাঠের পুতুল, মুর্শিদাবাদের পাটের পুতুল
• মেদিনীপুরের গালার পুতুল, বেণী পুতুল

পুতুল থেকে পুতুল নাচ। বঙ্গ সংস্কৃতির শিরায় শিরায় প্রবহমান এক ধারা। বাংলার সঙ্গে মিশে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া। নেপথ্যে তিতাস নদীর কূলের ছোট্ট গ্রাম কৃষ্ণনগরের বিপিন পালের কাহিনী। তিনিই সর্বপ্রথম প্রচলন করেন পুতুল নাচের। এপাড় বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে তা। ‘ভানু পেল লটারি’র দৃশ্যটা একবার ভাবুন। ঝুড়ি ভর্তি পুতুল। এ পাড়া থেকে সে পাড়ায় ফেরি করে বেড়ানো। মুখে, পুতুল নেবে গো?… ছোট্ট ঝু়ড়িতে রাম-রাবণ আছে। ইতিহাস বলে, ষোলোশো খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ছায়াপুতুল দিয়ে পুতুল নাচের শুরু। ইংরেজিতে যা শ্যাডোগ্রাফি।

পুতুল নাচের রকমফের

পুতুল নাচ সাধারণত দু ধরনের। ট্র্যাডিশনাল ও নন ট্র্যাডিশনাল।
ট্র্যাডিশনালে গ্লাভস পাপেট, স্ট্রিং পাপেট, স্টিক পাপেট আর শ্যাডো পাপেট, এই চারভাগে বিভক্ত। নন ট্র্যাডিশনাল অর্থে সময়ের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে পুতুল নাচে এসেছে অদলবদল। এর অন্যতম, ফিঙ্গার পাপেট শো৷ একটা সময় পুতুল নাচে আলো বলতে বোঝাত হ্যাজাক লাইট কিম্বা প্রদীপকে৷ যুগের বদলে সেখানে এসেছে বৈদ্যুতিক আলো। সাধারণত, পর্দার গায়ে সাদা-কালো বা রঙিন চামড়ার পুতুলের ছায়া ফেলে এই নাচের অনুষ্ঠান হয়৷

[আরও পড়ুনঃ জয়ের পর পুতিনকে ফোন করে ইউক্রেনে যুদ্ধ থামানোর আর্জি জানালেন ট্রাম্প

পুতুল ও পুতুল নাচের পদ্ধতি

বঙ্গ জীবনে জড়িয়ে, যাপনে জড়িয়ে এমন কিছু একটা … পুতুল নাচ। আভিজাত্য নেই। আতিশয্য নেই। স্রেফ ভালোবাসায় মোড়া। বেঁধে বেঁধে রাখা। সুতোর ঈশারায় মঞ্চ মাতানো বাহারি পুতুলে মজে আট থেকে আশি। আজও ঠিক আগের মতো করে। কচুরিপানার শিকড় দিয়ে চুল, অঙ্গভঙ্গি, বহুদূরের গ্রাম, ঝোঁপঝাড়, জলার শোলা তুলে তা থেকে গড়া পুতুল। হালকা চালে জমজমাট শো। নদিয়ার দড়ির পুতুল নাচ, উত্তর চব্বিশ পরগনার দণ্ড পুতুলনাচের নাম না করলেই নয়। কৃষ্ণনগরে আবার জলঙ্গির পাড় থেকে তুলে আনা মাটির পুতুলে বিশ্ব বাজিমাত। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এর শ্রীবৃদ্ধি। এখনও প্রায় ৪০০ পরিবার আছে, যারা এই পুতুল শিল্পের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এর মধ্যে প্রায় ২০০ পরিবার জড়িয়ে ঘূর্ণিতে। কালো পর্দা ফুঁড়ে ওঠা নিষ্প্রাণ রঙিন মানুষের দল। বাছা বাছা শব্দাবলী আওড়ে, কণ্ঠস্বরে, ‘কেবল কজন ওরা ঠোঁট নাড়ে’।

বালাসের পুতুল নাচ

উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জের বালাস গ্রামের পুতুল নাচ আজ বিস্তৃতপ্রায়। আর্থিক সংকটে আগের সেই জৌলুস আর নেই। স্মৃতির বাঁকে ভেসে ভেসে ওঠে সরকারদের পালার পুতুল।

বাংলা সাহিত্যে পুতুল-নাচ

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথায় পুতুল থেকেও নেই। নামে পুতুল, গপ্পে নয়। হারু ঘোষ, গ্রামের ডাক্তার শশী। অসামান্য নাস্তিক। শশীর পিতা সঙ্গে কুসুম। গপ্পে সুতোর অঙ্গুলিহেলনের বালাই নেই। বদলে ক্ষয়িষ্ণু সমাজের প্রেম-বিরহ-দ্বেষ-পারস্পরিক সহযোগিতার স্বরলিপি লেখে মানিকের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’। এমন রূপক আর আছে কী? শ্যাডো পাপেটে উল্লেখযোগ্য উপেন্দ্রকিশোরের ‘দুষ্টু বাঘ’।
অবন ঠাকুরের ক্ষীরের পুতুলে দুয়োরানি, তাঁর ক্ষীরেরপুত্র, ষষ্ঠী ঠাকুর আজও জ্বলজ্বলে।

বঙ্গসংস্কৃতি ও পুতুলনাচ

বাংলার জল, জঙ্গল, সাবেকিয়ানা,গ্রাম-জনপদ লোকগাথা, জীবন ও জীবিকায় জাপটে পুতুল নাচ। নদীমাতৃক সভ্যতা ও সংস্কৃতির ছত্রে ছত্রে জড়িয়ে এর রঙিন ধারা। জড়িয়ে ধর্মেও। অলক্ষ্মী পুজোয় তৈরি গোবরের লক্ষ্মী, চালের গুঁড়োর লক্ষ্মী-নারায়ণ-কুবেরের পুতুল। অঞ্চলভেদে টুসু-ভাদু-বড়ামের পরবে দেবদেবী, মানুষ ও পশুদের প্রতিমূর্তি। সবই পুতুল।….’বাজাও দোতারা/ সুন্দরী কমলা নাচে’…

মেলা ও পুতুল নাচ

বঙ্গ জীবনের জ্বলজ্বলে পার্বণ মেলা। সে যে মেলাই হোক। নাগরদোলা, বন্দুকে বেলুন ফাটানো, গরম জিলিপি, এক টাকার ফুলুড়ি, হারমোনিয়াম, সঙ্গে পুতুল নাচ। প্রেমিক-প্রেমিকা, মান-অভিমান। উঁকি দেন লতা মঙ্গেশকর। উথাল-পাথাল বুকে দিলদরিয়ার মান্না দে, নীল-সাদায় ঝুমুর-ঝুমুর, ছেলের মনের অসুখে বাবার অধরা ‘মন-কি-বাত’, মেয়ের বিয়ে আগে মায়ের মন খারাপ। চিকচিক করে চোখের কোণ। পুতুল মেলায় জীবন। জীবন মেলে পুতুল নাচে। নদিয়া, মেদিনীপুর, বর্ধমানের মেঠো-মেলার আঘ্রাণে ভুরভুর করে পুতুল নাচের সুবাস।

পুতুলনাচের শিক্ষা

সে ছিল এক সময়। গ্রামের মাঠে যাত্রা। নদীর কোল ঘেঁষে ছোট্ট মঞ্চ। বাঁশের বেড়া, প্লাস্টিকের ছাউনি। রাত জেগে, চোখ কচলে পুতুল নাচ দেখা। সপ্তকের মন্ত্রে রাজনীতির রণদামামা, ভোটপ্রচার, আকচাআকচি, তর্জন-গর্জন, নাটুকে সংলাপ। কখনও আবার সমাজ সচেতনতায় পুতুল নাচের ব্যবহার। ছেলের রক্ত চাই, মেয়ের বিয়েতে বাধা পণ, থ্যালাসেমিয়া… সব আসে ঘুরে ফিরে। কাঁধে হাত, হাতে হাত। ভরসা দিত পুতুল নাচ।
ফি বছর মেলার মাঠে বসন্ত এলেই মঞ্চ বাঁধার কাজ হতো। সরস্বতী পুজো, দোল উত্সবে একটা সময় যাত্রাকে টেক্কা দিত পুতুল নাচ, সেয়ানে সেয়ানে। বাঁশিতে লুটোপুটি খেত পূর্বরাগ, রঙিন দালানকোঠার স্বপ্ন। সে দিন আর নেই। পড়ে শুধু রঙিন পুতুলের সারি।

বাংলা সিনেমা ও পুতুল নাচ

লাঠির নীচে থাকা ছিদ্র। তার মধ্যে সুতো দিয়ে পুতুল নাচানো বাংলা সিনেমাতেও যে হয়নি, তা নয়। সঙ্গে মধ্যমা ও বুড়ো আঙুলের ব্যবহার। ১৯৬৩র ভ্রান্তিবিলাস, ৫৮র ভানু পেল লটারিতে সেই পুতুলের অনুরণন। এক ঝুড়ি রাম-রাবণ থেকে অহল্যার উপাখ্যান…. মন মজেছে দর্শককূলের।

সরকারি অনুদান

নগরায়নে মুখ লুকিয়েছে পুতুল নাচ। জীবন সায়াহ্ণে পুতুল শিল্পও। রাজ্যের তরফে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের সম্মান দেওয়া হয়েছে। মাসিক এক হাজার টাকা করে ভাতা দেওয়া হয় তাঁদের। অনেকেই পেয়েছেন সরকারি পরিচয়পত্র। তবু জ্বালানি, বিনোদনে কৃত্রিমতার চাপে পিষ্ট পুতুল নাচ। লম্বা খরচ। দর কমায় আগের মতো আর ভিড় হয় না। পেটে আরও চওড়া হয় টান। পেশা ছেড়ে অন্য পথে একলা হাঁটে পুরাতনদের আগামী। পুতুলের দল ভাঙে।

মেলার মাঠে বাঁশে বাঁধা প্যান্ডেল। তাতে রঙিন কাপড় তিরতির করে ওড়ে। সুতোয় নাচে আগামী। সংসার, জীবন সংগ্রাম, পেটের টান। পরবে পরবে পুতুল নাচ। বিকিকিনি, হুল্লোড়। ঠোঁটের কোণের হাসিটা ফিকে হতে হতে আসুক ফিরে। জ্বলে উঠুক অঘ্রাণের রাতে। প্রতীক্ষায় নাগর কানাই, প্রতীক্ষায় রাঈ….
পুতুল, নাচো তো দেখি….