Bangla Jago Desk: দীপাবলি, মানে আলোর উৎসব। এক সময় এই উৎসবের নাম শুনলেই মন ভরে উঠত এক অনাবিল জাদুতে। ঝলমলে নতুন পোশাক, মিষ্টির গন্ধ, হাসি-ঠাট্টা আর রাত আকাশের বাজি, যা ছোটবেলার দীপাবলিকে করে তুলত এক অনন্ত বিস্ময়। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেই চেনা উৎসবের রঙ যেন ফিকে হয়ে আসে। আলো তখনও জ্বলে, মিষ্টির স্বাদও এক থাকে, তবে সেই পুরনো ম্যাজিক আর খুঁজে পাওয়া যায় না। উৎসবের এই পরিবর্তন আসলে উৎসবের নয়, আমাদের ভেতরের পরিবর্তনেরই প্রতিচ্ছবি। ছোটবেলায় দীপাবলি ছিল একেবারে সরল। তখন সাজসজ্জার খরচ, মহাভোজের পরিকল্পনা কিংবা প্রথা-রীতির গভীর অর্থ নিয়ে আমাদের ভাবতে হত না। আমাদের জগৎটা ছিল ছোট, কিন্তু অফুরন্ত আনন্দে ভরপুর। প্রথম প্রদীপ জ্বালানো, হাতে ধরানো তারাবাতি, নতুন জামা পরার জন্য অধীর অপেক্ষা—এইসব ছোট্ট ছোট্ট জিনিস থেকেই আসত অপার আনন্দ। আমাদের খুশি ছিল নিছকই স্বতঃস্ফূর্ত, কারণ সেখানে কোনো প্রচেষ্টার প্রয়োজন ছিল না। আমরা পুরোপুরি সেই মুহূর্তেই বাঁচতাম (Diwali Nostalgia)।
আরও পড়ুনঃ দীপাবলি উদযাপনে বলিউড তারকারা, কেমন কাটল আলোর উৎসব?
কিন্তু বড় হয়ে আমরা বুঝতে পারি, এই একই উৎসবের জন্য এখন অনেক ‘effort’ দিতে হয়। প্রদীপগুলো নিজে থেকে ঝুলে যায় না, মিষ্টি নিজে থেকে তৈরি হয় না, আর সময়ের অভাব তো লেগেই থাকে। কাজ, দায়িত্ব আর মানসিক ক্লান্তির মাঝে দীপাবলির সেই উচ্ছ্বল আনন্দ এক শান্ত, আত্মসমীক্ষামূলক রূপে পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তন মন্দ নয়, শুধু ভিন্ন। এই সময় আমরা অনুভব করি, প্রাপ্তবয়স্কের জীবনে দায়িত্ব কীভাবে বিস্ময়কে সরিয়ে তার জায়গা করে নেয়। জীবনের পথে চলতে গিয়ে দীপাবলি যেন উৎসবের চেয়ে ‘নিখুঁত’-এর দিকে বেশি ঝুঁকেছে। ঘর হতে হবে ঝকঝকে, খাবার হতে হবে এলাহি, আর ছবিগুলো অবশ্যই ‘ইনস্টাগ্রাম-যোগ্য’। যে উৎসবের মূল সুর ছিল সংযোগ, তা ধীরে ধীরে যেন লোক-দেখানো প্রদর্শনীতে পরিণত হচ্ছে। অনেক প্রাপ্তবয়স্কের জন্য, বিশেষ করে মহিলাদের জন্য, দীপাবলি নিয়ে আসে এক অদৃশ্য চাপ—সবকিছু “ঠিকঠাক” করার মানসিক ও শারীরিক শ্রম। ঘর পরিষ্কার করা, সাজানো, রান্না করা, অতিথি আপ্যায়ন—এইসবের এক অন্তহীন চক্র। আর এত কিছুর পরেও নিজেদের জন্য উৎসব উপভোগের সময় যেন আর অবশিষ্ট থাকে না। সমাজ আমাদের বলে, দীপাবলি আনন্দের, হাসির, কৃতজ্ঞতার ও আলোকিত হওয়ার ঋতু। কিন্তু ঝলমলে আলোর নিচে অনেক মানুষ চাপা ক্লান্তি, দুঃখ বা একাকীত্ব বহন করেন, যা প্রকাশ করার ভাষা খুঁজে পান না। যে উৎসব একসময় শক্তি দিত, আজ যেন নীরবে তা দাবি করে (Diwali Nostalgia)।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে দীপাবলির তাৎপর্যও গভীর হয়। ছোটবেলায় তা ছিল নিছকই মজা, আর বড়বেলায় তা হয়ে ওঠে প্রতীকী—অন্ধকারের ওপর আলোর জয়, অশুভের ওপর শুভর জয়, হতাশার ওপর আশার জয়। কিন্তু আমরা উপলব্ধি করতে শুরু করি যে, ‘অন্ধকার’ কেবল বাইরে নয়; তা কখনও কখনও আমাদের ভেতরেও বাসা বাঁধে—মানসিক চাপ, অতিরিক্ত চিন্তা, চাপা আবেগ কিংবা এক নীরব শূন্যতা। প্রদীপ জ্বালানো তখন আর কেবল উৎসবের কাজ থাকে না, তা হয়ে ওঠে একপ্রকার বিশ্বাস—নিজেকে মনে করিয়ে দেওয়া যে ভেতরের শিখাটি যেন জ্বলতে থাকে, জীবন যতই কঠিন হোক। হয়তো আমরা আর ছোটবেলার মতো চিৎকার করে বা নেচে গেয়ে উৎসব করি না, কিন্তু শান্তভাবে উদ্যাপন করার মধ্যেও এক পবিত্রতা আছে। পরিণত বয়সের আনন্দ এক প্রদীপের আলোর মতো—স্থির, শান্ত এবং একান্তই ব্যক্তিগত। দীপাবলি ভিন্ন মনে হওয়ার আরও একটি কারণ হলো নস্টালজিয়া বা স্মৃতিকাতরতা। উৎসবগুলো যেন অনুপস্থিত মানুষ, স্থান বা সময়কে আরও বেশি করে সামনে এনে দেয়। যে বাড়িতে বড় হয়েছি, তা হয়তো আর আগের মতো নেই। কিছু মুখ চিরতরে হারিয়ে গেছে, কিছু সম্পর্ক পাল্টে গেছে, কিছু পুরনো প্রথা বিলীন হয়েছে (Diwali Nostalgia)।
দীপাবলির শব্দ আর গন্ধ পুরনো স্মৃতি উসকে দেয়—মায়ের হাতের লাড্ডু তৈরির গন্ধ, বাবার প্রথম প্রদীপ জ্বালানো বা ভাইবোনের তারাবাতি নিয়ে ছোটাছুটি। সেই মুহূর্তগুলো অভিজ্ঞতারূপে নয়, ফিরে আসে প্রতিধ্বনি হয়ে। মনে করে হাসি আসে, কিন্তু হৃদয়েও এক হালকা ব্যথা অনুভব হয়। বড় হওয়ার অর্থই হলো উপলব্ধি করা যে, আমরা চাই বা না চাই, সময় কখনও থেমে থাকে না। কিন্তু এই নস্টালজিয়ার ব্যথা আসলে ভালোবাসার প্রমাণ—প্রমাণ যে কিছু জিনিস একসময় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যার জন্য আজ মন খারাপ হয়। বয়সের সাথে সাথে দীপাবলি তার জমকালো রূপ ছেড়ে এক শান্ত কৃতজ্ঞতায় মোড়া রূপে আসে। জাঁকজমকের চেয়ে সম্পর্কের উপস্থিতি বেশি মূল্যবান মনে হয়। হয়তো প্রদীপ কম জ্বালানো হয়, কম মানুষের সাথে দেখা করা হয়, কিংবা বাজি ফাটানো বাদ দেওয়া হয়—কিন্তু এরপরে যে নীরবতা আসে, সেই শান্তিতেই আমরা শান্তি খুঁজে পাই। উত্তেজনার পিছনে না ছুটে আমরা শান্তি চাই। পরিবারের সাথে বসে থাকা, ঘরে তৈরি মিষ্টি ভাগ করে নেওয়া, গভীর রাত পর্যন্ত গল্প করা—এসব সাধারণ জিনিসই কোনো ঝলমলে কিছুর চেয়ে বেশি মূল্যবান মনে হয়। আনন্দ পরিণত হয় মাটিতে মেশা এক শান্ত অনুভবে।
Bangla jago fb page: https://www.facebook.com/share/17CxRSHVAJ/
আমরা শিখি, উৎসব আসলে কত কিছু করলাম, তার ওপর নির্ভর করে না, বরং কত গভীরভাবে অনুভব করলাম—তাতেই তার সার্থকতা। একটি প্রদীপ, যা আন্তরিকতার সাথে জ্বালানো হয়, রীতিনীতি মেনে জ্বালানো হাজার আলোর চেয়েও বেশি অর্থ বহন করে। আসলে দীপাবলি ভিন্ন মনে হয় কারণ উৎসব নয়, আমরা বদলেছি। সেই জাদু হারিয়ে যায়নি, তা কেবল পরিণত হয়েছে। সেটা আর বাজির শব্দে নয়, তা এখন প্রদীপ জ্বালানোর সেই শান্ত কাজে, যা মনে করিয়ে দেয়—জীবনের পথে যত বাধাই আসুক, ভেতরের আলো সবসময় থাকবে। হয়তো একই অনুভূতি ধরে রাখার দরকার নেই, নতুন অনুভূতির মধ্যে বড় হওয়াটাই আসল। ছোটবেলায় যা ছিল আশা, যৌবনে তা হয়ে ওঠে শক্তি, আর পরিণত বয়সে তা এনে দেয় শান্তি। দীপাবলি এখন ভিন্ন লাগলে তাতে ক্ষতি নেই। এর মানে, আপনি বদলেছেন, আর উৎসব আপনাকে আপনার বর্তমান অবস্থাতেই স্বাগত জানাচ্ছে। এটি কেবল আপনাকে মনে করিয়ে দেয়—জীবন যতই পরিবর্তিত হোক না কেন, আলো সবসময় ফিরে আসে (Diwali Nostalgia)।