Bangla Jago Desk : খাদের ধারের রেলিঙ, কন্টিনেন্টাল ডিশ আর টিটোরিয়া। “খাদের ধারে রেলিঙটা, সেই দুষ্টু দোদো সিরিংটা”। বাঙালির হৃদয়ে দার্জিলিংকে নিয়ে আবেগকে আরও একটু বেশি খুঁচিয়ে দেওয়ার জন্য বিখ্যাত অঞ্জন দত্তর এই গানের লাইনগুলি যদি মনে থাকে তাহলে শৈলশহরে গেলে এমন রেস্তোরাঁ খুঁজে নিতে ইচ্ছে হয়ই যেখানে সত্যিই খাদের ধারের রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়ানো যায়। আর যদি এমন রেস্তোরাঁ কারো পছন্দ হয়ে থাকে তাহলে ম্যালের ধারে ‘টিটোরিয়া’ চোখ টানবেই। বিধিসম্মত সতর্কীকরণ হিসেবে বলে রাখা ভাল, গোল্ডেন টিপসের মতো বিখ্যাত চা প্রস্তুতকারক সংস্থা এই রেস্তোরাঁর যে-কোনও খাবারের দাম একটু বেশি। কিন্তু যদি শুধু বাতাসিয়া লুপ দেখে কারোর মন না ভরে থাকে, আরও ‘প্যানোরামিক’ ভিউয়ের জন্য হৃদয় এবং মস্তিষ্ক একই সঙ্গে উশখুশ করে, তাহলে ‘টিটোরিয়া’ লা-জবাব।
মন ভাল করা রোদ ঝলমলে দিনে ‘টিটোরিয়া’য় বসার জন্য উপরের তলার ছাদ খোলা লাউঞ্জ রয়েছে, যেখানে সত্যিই মেঘ কখনো-কখনো আপনার নীচে থাকে। সালমান খান, মনীষা কৈরালার সেই বিখ্যাত ছবি, ‘খামোশি’ যা দিয়ে বলিউডে সঞ্জয় লীলা বনসালির অভিষেক হয়েছিল, তাতে বিখ্যাত গানটির লাইন ছিল, “আসমা উপর, আসমা নীচে”। ‘টিটোরিয়া’র ওপরের লাউঞ্জে বসে দার্জিলিং টি কিংবা কফিতে চুমুক দিতে দিতে আপনার এইসব হাজারো স্মৃতি মাথায় আসবেই। সকালে ব্রেকফাস্টের জন্য আসতে পারেন এই রেস্তোরাঁয়, আসতে পারেন দুপুরের মধ্যাহ্ন ভোজ সারতেও। ‘টিটোরিয়া’র বিশেষত্ব কন্টিনেন্টাল ডিশে, দুপুরে পাস্তা উইথ হোয়াইট সস কিংবা পিৎজা অর্ডার করলে মন ভাল হয়ে যায়। এই রেস্তোরাঁর অবশ্য ক্যাচ লাইনই হচ্ছে, শুধু ফুড নয়, “অ্যাম্বিয়েন্সটা”ও দেখুন। রেলিঙে হেলান দিয়ে সামনের হিমালয় পর্বতশ্রেণি দেখতে পেলে অবশ্য সেই আপ্তবাক্যে ভরসা রাখতেই হয়।
আর যেদিন মন খারাপ করা মেঘ থাকে অথবা ‘পৃথিবীর ছাদে’ গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে হয় না, সেদিনও নীচের তলায় চমৎকার বসার বন্দোবস্ত রয়েছে ‘টিটোরিয়া’য়। জানলার ধারে বসতে পারেন। বাইরের দিকে তাকালে হয়তো সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ সিনেমার অনেক আইকনিক সংলাপ মনে পড়ে যেতে পারে। মন খারাপে, ভালবাসা কিংবা ভালবাসা নিবেদনে। পছন্দের কাউকে সঙ্গী হিসেবে পেলে ‘টিটোরিয়া’র নীচের তলাতেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে। বলে রাখা ভাল যে এই রেস্তোরাঁর কন্টিনেন্টাল দুর্দান্ত হলেও, মোমো কিংবা স্যান্ডউইচ না চাখাটা ভুল হয়ে যেতে পারে। এমনিতে দার্জিলিঙের বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় মোমো নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা হয়। এমনই সেই পরীক্ষানিরীক্ষার বিস্তৃতি যে আমার অনেক বিদেশের প্রবাসী বন্ধুও, নিউ ইয়র্কের চায়না টাউন কিংবা রোমের চায়না টাউনে বিভিন্ন ডিশ চাখলেও দার্জিলিঙের মোমো নিয়ে এখনও স্মৃতিমেদুরতা থাকে। কিন্তু ‘টিটোরিয়া’ শুধু স্বাদে নয় আকারে, রঙে মোমো নিয়ে এমন সব নতুনত্ব উপহার দেয় যে ভোলা মুশকিল।
‘টিটোরিয়া’ থেকে বেরিয়ে আসবার সময় ডানদিকের ফলকটার দিকে নজর রাখবেন। দিকনির্দেশ করে বলে দেওয়া আছে ডানদিকে যে রাস্তাটি নীচের দিকে নেমে গিয়েছে সেই রাস্তাতেই একটি বাড়িতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস মারা গিয়েছিলেন। ইতিহাস বলে, ১৯২৫ সালে অসুস্থ চিত্তরঞ্জন দাস দার্জিলিঙে “হাওয়া বদলের” জন্য গিয়েছিলেন। তাঁকে দার্জিলিঙে দেখতে এসেছিলেন স্বয়ং মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। বাঙালির হৃদয় উথালপাথাল করে দেওয়ার মতো স্মৃতি দার্জিলিঙের নস্টালজিয়া আর মেঘের মতো ভেসে বেড়ানো টুকরো টুকরো স্মৃতিকে হাত বাড়িয়ে ধরতে চাইলে ‘টিটোরিয়া’য় আসাটা বাধ্যতামূলক হতে পারে।