চিত্র: প্রতীকী
Bangla Jago Desk: স্ট্রোক যে চোখেও হতে পারে, সে সম্পর্কে হয়তো অনেকেরই ধারণা নেই। চোখ হল শরীরের সবচেয়ে স্পর্শকাতর ইন্দ্রিয়। চোখে স্বাভাবিক রক্ত চলাচল ব্যাহত হলে চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্ট্রোক কিন্তু সাধারণত একই সঙ্গে দু’টি চোখে হয় না। তবে, রোগ নির্ণয়ে বা চিকিৎসায় গাফিলতিতে নষ্ট হতে পারে দু’টি চোখেরই দৃষ্টিশক্তি। চোখের স্ট্রোক কী? কেন হয়? কী করনীয়? চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পূর্ণ সেরে ওঠা কী সম্ভব? জানালেন বিশিষ্ট চিকিৎসক চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ডক্টর শিল্পী শর্মা। কথা বলেছেন আমাদের প্রতিনিধি অর্পিতা বসু।
প্রশ্ন : চোখে স্ট্রোক হয় কেন?
উত্তর: যখন চোখের রেটিনায় রক্ত সরবরাহকারী প্রধান ধমনী বা শিরায় রক্ত সরবরাহ বাধাপ্রাপ্ত হয় তখন রেটিনায় কিছুটা পরিবর্তন দেখা যায়। তাতে দৃষ্টি শক্তিও হ্রাস পায়। ডাক্তারি পরিভাষায় এই পরিস্থিতিকে বলা হয় চোখের স্ট্রোক।
প্রশ্ন: একসঙ্গে কী দুটো চোখেই স্ট্রোক হতে পারে?
উত্তর: সাধারণত, একসঙ্গে দুটি চোখে স্ট্রোক হয় না। একটি চোখে স্ট্রোক হবার পর অল্প সময় বা কয়েক দিনের ব্যবধানে অন্য চোখে স্ট্রোক হতে পারে। তবে এক বা ২ শতাংশ ক্ষেত্রে একসঙ্গে দুটি চোখেই স্ট্রোক হতে পারে।
প্রশ্ন: লক্ষণ কী?
উত্তর: চোখের স্ট্রোকের লক্ষণ গুলি হল-
১)হঠাৎ করে ব্যথা ছাড়া দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায়। যা চোখের বিভিন্ন অংশে প্রভাব ফেলতে পারে।
২) হঠাৎ করে মনে হতে পারে চোখের সামনে উপর থেকে নিচে যেন কালো পর্দার অনুভূতি।
৩)চোখের সামনে মনে হবে যেন কিছু একটা ভাসছে। এগুলিই হল ফ্লোটার কণা। যখন চোখে রক্ত বা অন্য কোনও তরল বের হয়, তখন এমন হয়ে থাকে।
৪) অনেক ক্ষেত্রে পেরিফেরাল ভিশন লস হয় অর্থাৎ শুধুমাত্র সামনের কোন কিছু দেখতে পাচ্ছেন, কিন্তু পাশের কোন কিছু দেখা সম্ভব হচ্ছে না।
তাই যদি হঠাৎ করে এক বা উভয় চোখে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায় বা ঝাপসা দেখতে পান, তাহলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
প্রশ্ন: চোখের স্ট্রোক কি নিয়মিত স্ট্রোক থেকে আলাদা?
উত্তর: চোখের স্ট্রোক নিয়মিত স্ট্রোক থেকে আলাদা। চোখের স্ট্রোকে রেটিনায় রক্ত প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়, নিয়মিত স্ট্রোক মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহকে প্রভাবিত করে।
প্রশ্ন: কাদের চোখে স্ট্রোক হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে?
১)যাঁদের বয়স ৬০-এর বেশি।
২)যাঁদের উচ্চরক্তচাপ, কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিসের সমস্যা আছে, যারা গর্ভনিরোধক পিল ব্যবহার করেন, তাদের চোখে স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
৩)পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের চোখের স্ট্রোকের ঝুঁকি কম।
৪)আগে স্ট্রোক হয়েছে এমন ব্যক্তি, যাদের হৃদরোগ বা করোনারি ধমনীর রোগ আছে, তাদেরও চোখের স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি থাকে।
৫)যাদের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রক্ত জমে যাওয়া প্রবণতা আছে তারাও ঝুঁকি পূর্ণ।
৬)যাদের গ্লুকোমা রয়েছে বা যাদের এক্সিয়াল লেন্থ কম থাকে, চিকিৎসা পরিভাষায় যাকে হাইপারমেট্রোপিয়া বলে তারাও ঝুঁকিপূর্ণ।
৭))ধূমপান এবং মদ্যপান স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকটা বাড়িয়ে দেয়।
প্রশ্ন: এর চিকিৎসা কী?
উত্তর: এই ধরনের সমস্যা নিয়ে যখন রোগীরা আমাদের কাছে আসেন, তখন প্রথমেই কিছু শারীরিক পরীক্ষা, রক্তচাপের পরীক্ষা এবং চোখের কিছু পরীক্ষা করে দেখা হয়। এরপর ধাপে চোখের ‘vision test’, slit lamp exam’ ‘Intraocular pressure measurement’
( IOP), ‘Dilated fundoscopy’ করা হয়। পাশাপাশি কিছু ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা এবং প্রয়োজনীয় রক্ত পরীক্ষার করা হয়। এর মাধ্যমে বোঝা যায় চোখ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শুরু করা হয়।
প্রশ্ন: চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পূর্ণ সেরে যাওয়া সম্ভব?
উত্তর: রেটিনাল ধমনী বা শিরায় ব্লক হলে, দ্রুত চিকিৎসা শুরু না হলে, দৃষ্টিশক্তি স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। শুধুমাত্র অল্প সময়ের জন্য দৃষ্টিশক্তি কমে গেলে, চিকিৎসা করে অনেকটাই ফিরি আনা সম্ভব। চোখের স্ট্রোক শনাক্ত হওয়ার পর যত দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা যায়, দৃষ্টিশক্তি পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা তত বেশি থাকে।
প্রশ্ন: চোখের স্ট্রোক কী বড় কোনো স্ট্রোকের ইঙ্গিত দেয়?
উত্তর: অবশ্যই। রেটিনাল স্ট্রোকের ক্ষেত্রে প্রথমবার স্ট্রোক হবার পর ৪.৯৬ শতাংশ রোগীদের একমাসের মধ্যে সেরিব্রাল স্ট্রোক হবার সম্ভাবনা থাকে। ৯ শতাংশ রোগীদের এক বছরের মধ্যে সেরিব্রাল স্ট্রোকের সম্ভাবনা থাকে।তাই, প্রথম স্ট্রোকের পর দ্রুত এবং সঠিক চিকিৎসার প্রয়োজন, এবং হৃদরোগের ঝুঁকিও নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
প্রশ্ন: একবার চোখে স্ট্রোক হবার পর আবারও কী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে? কিভাবে তা এড়ানো সম্ভব?
উত্তর: একটা চোখের স্ট্রোক হবার পর, দ্বিতীয় চোখে স্ট্রোক হবার সম্ভাবনা থাকে। রেটিনাল ভেইন অক্লুশনের (RVO) ক্ষেত্রে ১ শতাংশ রোগীদের এক বছরের মধ্যে এবং ৭ শতাংশ রোগীদের মধ্যে ৫ বছরের মধ্যে আবারও স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তা এড়াতে, উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি, প্রয়োজন লাইফস্টাইল ম্যানেজমেন্টের। হৃদরোগের ঝুঁকি এড়ানো প্রয়োজন।
প্রশ্ন: চিকিৎসার সাথে সাথে খাদ্য তালিকার দিকেও কী নজর দেওয়া উচিত?
উত্তর: হ্যাঁ, খাদ্য তালিকার ওপর নজর দেওয়া উচিত ।
১) যাদের উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসের সমস্যা রয়েছে তাদের সেই অনুযায়ী খাবার খাদ্য তালিকায় রাখা উচিত।
২)সাইট্রাস জাতীয় ফল, সামুদ্রিক মাছ খুবই উপকারী।
৩)ভিটামিন সি, ভিটামিন ই এবং মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার খান।
৪) ওমেগা-3 ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যুক্ত খাবার খাদ্য তালিকায় রাখুন। ৫)ধূমপান এবং মদ্যপান এড়িয়ে চলুন।
প্রশ্ন: সেক্ষেত্রে রুটিন চেকআপ কতটা জরুরি?
উত্তর: চোখের স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে নিয়মিত চোখের পরীক্ষা করা খুবই জরুরি। যাদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা চোখের অন্যান্য সমস্যা আছে তাদের নিয়মিত চোখের পরীক্ষার মাধ্যমে স্ট্রোকের মতো সমস্যা প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা সম্ভব।
প্রশ্ন: সবশেষে পাঠকদের উদ্দেশ্যে কী বলতে চাইবেন?
উত্তর: ১) চোখের স্ট্রোক থেকে সুস্থ থাকতে হলে,কোনো সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ দ্রুত চিকিৎসার মাধ্যমে রেটিনার ক্ষতি কমানো সম্ভব, এবং দৃষ্টিশক্তি পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনাও বাড়ে।
২)যাদের অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের সমস্যা রয়েছে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
৩) একবার স্ট্রোক হয়ে গেলে রুটিন চেকআপে থাকা প্রয়োজন।
৪)স্বাস্থ্যকর খাবার, পর্যাপ্ত ঘুম এবং নিয়মিত ব্যায়াম চোখের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
৫)চোখের উপর অতিরিক্ত চাপ না দিয়ে, পর্যাপ্ত বিশ্রাম দেওয়া উচিত।