চিত্র: সংগৃহীত
Bangla Jago Desk: মস্তিষ্কের বিকাশ জনিত সমস্যার নাম অটিজম। যত তাড়াতাড়ি শিশুদের এই সমস্যার কথা জানতে পারা যাবে, তত তাড়াতাড়ি তাদের চিকিৎসা সম্ভব। তবে সব অটিস্টিক শিশুদের সমস্যা একই রকম হয় না। তাই কতটা সমস্যা রয়েছে তা বোঝা সবার আগে দরকার। আগে অটিজম সম্পর্কে অনেকেই সচেতন ছিলেন না। এখন মানুষের সচেতনতা বাড়ছে। ঠিক সময় চিকিৎসা করালে অনেক ক্ষেত্রে এদের অনেককেই সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কী লক্ষণ দেখা দেয়? কখন সচেতন হবেন? কী করনীয়? জানাচ্ছেন বিশিষ্ট চিকিৎসক অধ্যাপক, ড. অদিতি বন্দ্যোপাধ্যায়। কথা বলেছেন আমাদের প্রতিনিধি অর্পিতা বসু।
প্রশ্ন : আপনারা বলেন অটিজম কোনও রোগ নয়, এটা এক ধরনের ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার। অটিজম কী?
উত্তর : অটিজম কোনও রোগ বা মানসিক রোগ নয়। এটি একটি অনন্য চিন্তাধারা, যেখানে শিশু নিজের মত একটা অন্যরকম জগৎ তৈরি করে। এটি মস্তিষ্কের বিকাশ জনিত সমস্যা। এক্ষেত্রে শিশুটির সামাজিক বিকাশ ঠিকমতো হয় না, অন্যদের সাথে সে ঠিকমতো কথা বলতে পারে না, মিশতে পারে না। কথা বলা শুরু হতে বেশ দেরি হয়, একই কাজ বারবার করতে থাকে। অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারে এইরকম নানাবিধ সমস্যা দেখা যায়।
প্রশ্ন : কী কারনে একটি বাচ্চা অটিস্টিক হয়?
উত্তর : সঠিকভাবে এখনও অটিজমের কারণ জানা যায়নি। এর সঠিক কারণ সম্পর্কে অনুসন্ধান চলছে। জিন ঘটিত কারণে অটিজম হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। আমাদের মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রের বিভিন্ন কোষ গুলির পারস্পরিক সংযোগ কমে যাওয়া অটিজমের একটা বড় কারণ। এছাড়াও এতদিন পর্যন্ত অটিজমের জন্য বিভিন্ন কারণকে দায়ী করা হত, তবে কোনটাই সঠিক বলে প্রমাণ হয়নি।
প্রশ্ন : একজন অটিস্টিক বাচ্চার কি ধরনের সমস্যা হচ্ছে অনেক সময় বাবা মা বুঝে উঠতে পারে না সেক্ষেত্রে তাদের সমস্যাটা বোঝা বাবা-মায়ের কাছে কতটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে যায়?
উত্তর : বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুটির মা-বাবা বুঝেই উঠতে পারেন না, তাঁর শিশুর মধ্যে কোনও সমস্যা আছে। হাত দিয়ে কোনও জিনিস দেখানো বা অন্যান্য শিশুদের মতন মনের ভাব এরা প্রকাশ করতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মা হয়তো ভাবেন তাঁর শিশুটি স্বাভাবিকভাবেই একটু দেরিতে কথা বলছে বা তার বিকাশ একটু দেরিতে হচ্ছে। ফলে বুঝে উঠতে বেশ খানিকটা সময় চলে যায়।
প্রশ্ন : একজন অটিস্টিক বাচ্চার মধ্যে কী ধরনের লক্ষণ দেখা যায়?
উত্তর : অটিজম আক্রান্ত শিশুদের তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। অল্প, মাঝারি, তীব্র।
১) অন্য শিশুদের সাথে মেশার অক্ষমতা।
২) অনেক ক্ষেত্রে কথা বলা শুরু হতে বেশ দেরি হয়।
৩) আবার কথা বলতে না পারার সাথে সাথে আকার ইঙ্গিতেও কিছু বোঝানোর ক্ষেত্রে অক্ষমতা থাকে।
৪) কোনও নির্দিষ্ট জিনিসের প্রতি এদের আকর্ষণ থাকে।
৫) একই কাজ বারবার করা।
৬) এদের তাকানোর ধরণটা একটু অন্যরকম হয়। সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে এরা কথা বলতে পারে না।
৭) এছাড়াও অনেক সময় এরা হাইপার অ্যাকটিভ হয় এবং স্লিপলেসনেসের মতন নানা ধরনের সমস্যা দেখা যায়।
প্রশ্ন: অটিস্টিক বাচ্চারা কি অনেক বেশি ইন্টেলিজেন্ট হয়?
উত্তর: অটিজম আক্রান্ত শিশুরা অনেক সময় বিশেষ গুণে পারদর্শী হয়। তবে মনে রাখা দরকার সবাই নয়। এখানে তারতম্য থাকে। অনেক সময় এদের ফটোগ্রাফিক মেমরি দেখা যায়। অর্থাৎ যে রাস্তা দিয়ে তারা একবার যায় সেই রাস্তাটা তারা কখনো ভোলে না। বরং সেই রাস্তা দিয়ে না নিয়ে গেলে তারা বিরক্ত হয়। কেউ ভালো গান করতে পারে, আঁকতে পারে, কার কারও খেলার দিকে ঝোঁক থাকে। তবে তার সাথে এটাও মনে রাখতে হবে এদের সামাজিক বিকাশ ঠিকমতো হয় না।
প্রশ্ন: অনেক সময় ধরে নেওয়া হয় স্বাভাবিক কারণেই বাচ্চাটি দেরিতে কথা বলছে। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় সেটাই একটা বড় সমস্যা। বাবা মার ঠিক কোন সময় থেকে সচেতন হওয়া প্রয়োজন?
উত্তর: সমস্যাগুলো কিন্তু খুব ছোট বয়স থেকেই লক্ষ্য করা যায়। অটিস্টিক বাচ্চাদের আচার-আচরণে কিছু সুস্পষ্ট লক্ষণ প্রকাশ পায়। একে বলা হয় ‘বিহেভেরিয়াল সিম্পটম’। বেশি মানুষজন এরা পছন্দ করে না। চেনা গণ্ডির বাইরে এরা যেতে চায় না। যে বাচ্চাটি প্রথমে হয়তো একটা দুটো শব্দ বলছিল হঠাৎ করে কথা বলাই বন্ধ করে দিল। আবার কেউ কেউ হয়ত কথাই বলছে না। এরা নিজের মত একটা জগতে থাকতে চায়। হয়তো পাখা ঘুরছে সেদিকেই সে তাকিয়ে থাকবে , নাম ধরে ডাকলেও সাড়া দেবে না। একই কাজ বারবার করছে। চোখের দৃষ্টি একটু অন্যরকম।এই ধরনের কোনও লক্ষণ বা সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
প্রশ্ন: গর্ভস্থ অবস্থায় একটি শিশুর অটিজমের সমস্যা আছে কিনা তা কি বোঝা সম্ভব?
উত্তর: না। তা বোঝা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন: চিকিৎসার মাধ্যমে কি অটিজমের সমস্যার সম্পূর্ণ সারানো সম্ভব?
উত্তর: এর নির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা নেই। অটিজম সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব নয়। তবে জীবন যাত্রার মানোন্নয়ন সম্ভব। কোনও শিশুর মধ্যে অটিজমের লক্ষণ প্রকাশ পেলে কিছু থেরাপি করা হয়। স্পিচ থেরাপির মাধ্যমে তাদের কথা বলার সমস্যা কিছুটা ঠিক হয়। যারা খুব হাইপার তাদের জন্য অকুপেশনাল থেরাপি, পড়াশুনা এবং সামাজিক বোধ তৈরি করার জন্য স্পেশাল এডুকেটর লার্নিং থেরাপি এবং বিহেভেরিয়াল থেরাপি করা হয়। এছাড়াও ডান্স মুভমেন্ট, প্লে থেরাপি এবং বিভিন্ন রকম খেলার ক্লাস তাদের মধ্যে সামাজিক বোধ তৈরি করতে সাহায্য করে।মানসিক এবং স্নায়ুর সমস্যা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গেলে ওষুধ দেবার প্রয়োজন হয়।
প্রশ্ন : এই ধরনের থেরাপি কতদিন ধরে করার প্রয়োজন হয়?
উত্তর : অনেক ক্ষেত্রেই থেরাপি দীর্ঘ সময় ধরে প্রয়োজন হয়। যা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে শিশুটির সমস্যা ঠিক কতটা তার ওপর।
প্রশ্ন : একজন অটিস্টিক বাচ্চার বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কী বিশেষ ধরনের স্কুলের প্রয়োজন? নাকি সাধারণ বাচ্চার সাথে স্বাভাবিকভাবে সে পড়াশোনা করতে পারে?
উত্তর : প্রতিটি স্কুল এই ধরনের শিশুদের ভর্তি নিতে বাধ্য হলেও বাস্তবে অনেক স্কুলেই পরিকাঠামো নেই। অথচ সুযোগ পেলে এই শিশুরা সাধারণ স্কুলে লেখাপড়া করে বড় হতে পারে, যদি পরিকাঠামো থাকে।
অনেক অভিভাবকরাও চান না তাদের সন্তান স্পেশাল স্কুলে ভর্তি হোক। অটিস্টিক শিশুদের একটু বাড়তি যত্ন প্রয়োজন। অনেক স্কুলে স্পেশাল এডুকেটর থাকলেও অটিস্টিক শিশুকে ভর্তি নিতে চান না স্কুল কর্তৃপক্ষ। অনেক অভিভাবকদেরই এমন অভিজ্ঞতার শিকার হতে হয়। সাধারণ স্কুলে অটিস্টিক বাচ্চাদের কিভাবে পড়ানো উচিত তা নিয়ে স্কুলে আরও বেশি ওয়ার্কশপের প্রয়োজন। দরকার আরও উন্নত পরিকাঠামো এবং সামাজিক সচেতনতা।
প্রশ্ন: এখনও পর্যন্ত আমাদের সমাজে একটা অটিস্টিক বাচ্চাকে নিয়ে বাবা-মাকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কোথাও গিয়ে কী মনে হয় এটা এখনো একটা ‘সোশ্যাল ট্যাবু’ হিসেবে রয়ে গেছে?
উত্তর: কিছু ক্ষেত্রে তো বটেই। শহরাঞ্চলে অনেকেই অটিজম সম্পর্কে সচেতন হলেও গ্রামাঞ্চলে এখনও অনেকেরই অটিজম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই। ফলে সেখানে অটিস্টিক বাচ্চাদের নিয়ে বাবা মাকে নানান সমস্যায় পড়তে হয়। কমিউনিটি লিভিং একটি সমাধান হতে পারে। আর পাঁচটা বাচ্চার সঙ্গে তুলনা না করে একটি অটিস্টিক শিশুর বিকাশ নিয়ে ভাবা দরকার। না হলে কোথাও গিয়ে বাচ্চাটিকে অবসাদ গ্রাস করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারের সদস্যদেরই সমর্থন পাওয়া যায় না সন্তানকে বড় করে তোলার ক্ষেত্রে।
সন্তানের বয়স সন্ধির সময় অভিভাবকদের চিন্তা আরও বেড়ে যায়। কারণ এই সময়ের শারীরিক নানান বদল আসে। তার সাথে মানসিক বিকাশের দিকটির মিল থাকে না। তাই অভিভাবকদেরও একটা চিন্তা থাকে বয়স বাড়ার সাথে সাথে বা তাদের অবর্তমানে কিভাবে তাঁর সন্তানের যত্ন সম্ভব। প্রথমেই বুঝতে হবে আপনার সন্তান অসুস্থ নয়, শুধু অন্যদের থেকে একটু আলাদা। তাই প্রয়োজন শুরু থেকেই সঠিক পরিকল্পনার।