সুব্রত দত্ত: বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। জানেন এই বিখ্যাত বাড়ি কবে গড়ে উঠেছিল? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবার আগে কোথায় থাকতেন? বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় কলকাতার আদি বাসিন্দা ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবার। তাঁর পূর্বপুরুষরা পূর্ববঙ্গে বসবাস করতেন। এই পরিবারের পদবী ‘ঠাকুর’ ছিল না। পিরালি ব্রাহ্মণ ছিলেন তাঁর পরিবার। কলকাতায় আসার পর ঠাকুর পদবী লাভ করেন এই পরিবার। যশোরের পিরালি ব্রাহ্মণ পুরুষোত্তম কুশারীর বংশধর ছিলেন তাঁরা। এই পরিবারের সদস্য পঞ্চানন কলকাতায় এসে প্রথম বসবাস শুরু করেন। সেই সময় পাথুরিয়াঘাটা এলাকায় থাকতে শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষরা। পঞ্চানন কলকাতায় আসার পর ঠাকুর পদবী লাভ করেন।
ইংরেজদের সঙ্গে তখন থেকেই এই পরিবারের ব্যবসা সংক্রান্ত সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। লেখক লোকনাথ ঘোষের ‘বাবু বৃত্তান্ত’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ব পুরুষদের অনেক তথ্য বর্ণিত রয়েছে। ওই গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ঠাকুর পরিবারের আদিপুরুষ ছিলেন ভট্টনারায়ণ। এই পরিবারের একবিংশ পুরুষ পুরুষোত্তম পীর আলি খাঁ নামক একজন আমিনের ভোজসভায় গিয়েছিলেন। নিষিদ্ধ ভোজ্যের ঘ্রাণ নেওয়ায় তাঁকে তৎকালীন ব্রাহ্মণ সমাজ দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। সেই সময়ের ব্রাহ্মণ সমাজের কঠোর অনুশাসনে পীর-আলি থেকে পিরালি হিসাবে সেই সময় চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিলেন এই পরিবার। পরবর্তীতে পিরালি ব্রাহ্মণ বংশ হিসাবে পরিচিতি পায়।
ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত হওয়ার ফলে অল্প সময়ের মধ্যে ধনী হয়ে ওঠেন পরিবারটি। বিপুল অর্থ সমাগম হয়। বিশেষ করে পঞ্চানন ঠাকুরের পৌত্র নীলমণি ঠাকুর ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করে বিপুল সম্পদের মালিক হন। এই নীলমণি ঠাকুরই পরবর্তীতে পৈতৃক নিবাস পাথুরিঘাটা ছেড়ে নতুন বাড়ি তৈরি করেন জোড়াসাঁকোয়। বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে জানা যায়, বৈষ্ণবচরণ শেঠের জমি কিনে ঠাকুর বাড়ির পত্তন করেন তিনি।
প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর নীলমণি ঠাকুরের পৌত্র ছিলেন। দ্বারকানাথ ঠাকুর এই ব্যবসাকে আরও শ্রীবৃদ্ধি ঘটান। বঙ্গদেশে একাধিক পরগনা কিনে নেন তিনি। শুধু বঙ্গদেশে নয়, তাঁর জমিদারির বিস্তার ঘটান উড়িষ্যাতেও। দ্বারকানাথ ঠাকুরের ব্যবসা-বুদ্ধি, অর্থবল ও ব্যক্তিত্বের কারণে ঠাকুর পরিবার কলকাতার বুকে একটি ধনী পরিবারে পরিণত হয়। ঠাকুর পরিবার তৎকালীন কলকাতার অন্যতম ক্ষমতাশীল ও অভিজাত একটি পরিবারে উন্নীত হয়েছিল দ্বারকানাথ ঠাকুরের হাত ধরে।
সেই সময় জমিদারি ক্রমশ বিস্তার ঘটতে থাকে। পাশাপাশি ইংল্যান্ডের সঙ্গে সরাসরি আমদানি রফতানির ব্যবসা চলতে থাকে এই পরিবারের। জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের জমিদারি সেই সময় বিস্তার লাভ করেছিল পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) এবং ওড়িশায়। এইসব এলাকায় কোনও জমিদারি নিলামে ওঠার খবর পেলেই সেখানেই পৌঁছে যেতেন দ্বারকানাথ। এইভাবে একের পর এক বিশাল জমিদারি ক্রয় করেন দ্বারকানাথ ঠাকুর।
সেই সময় পূর্ববঙ্গে এই জমিদারির আওতায় ছিল নদিয়ার কুষ্টিয়া, বিরাহিমপুর (সদর শিলাইদহ), পাবনা জেলার শাহজাদপুর পরগণা (সদর শাহজাদপুর, বর্তমান সিরাজগঞ্জের অন্তর্গত) এবং রাজশাহী জেলার কালীগ্রাম পরগনা (সদর পতিসর, বর্তমান নওগাঁর অন্তর্গত)। এছাড়া সামান্য কিছুদিনের জন্য পাবনার পত্তনী তালুক তরফ চাপড়ি, রংপুরের স্বরূপপুর এবং যশোরের মোহাম্মদশাহীতে ছোট ধরণের জমিদারি কিনেছিলেন দ্বারকানাথ।
তাঁর পুত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এসব পছন্দের ছিল না। জমিদারির দেখাশোনার দায়িত্ব কাঁধে নিলেও তিনি ছিলেন ধার্মিক ও তত্ত্বজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ। বিষয় আশয়ের প্রতি তার একেবারেই আগ্রহ ছিল না। ফলে নতুন করে জমিদারি বাড়ানোর লক্ষ্যে এগোননি তিনি। সেই সময়কার বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারির প্রসার ঘটাতে পারেননি। তবে ভূ-সম্পত্তির পরিচালন ব্যবস্থা সুসংহত করেছিলেন।
পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাবার দায়িত্ব অনেকটাই কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। কাছারি বাড়িতে গিয়ে তিনি জমিদারি পরিচালনা করতেন। কখনও শিলাইদহ বা কখনও কুষ্টিয়া, পতিসর ছুটে যেতেন। জলপথে যেতে যেতে প্রকৃতির রূপ তাঁকে পাগল করে তুলতো। খাল-বিল, নদ-নদী, শষ্যক্ষেত, শরৎ, হেমন্ত, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত এমনকি পদ্মার উত্তাল বুকের উপর শৈল্পিক বক্ররেখায় উড়ে যাওয়া পাখির ঝাঁক আর সর্বোপরি মানুষ, সবই জায়গা করে নিয়েছিল তার লেখায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একাধিক কালজয়ী রচনা এই সব কাছারি বাড়ি থেকে সৃষ্টি হয়েছিল। কলকাতা থেকে বহু দূরে দিনের পর দিন কাটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। উপলব্ধি করেছেন সাধারন মানুষের দুঃখ যন্ত্রণাকে। উপলব্ধি করেছেন মানুষের জীবনযাত্রাকে। দু’চোখ ভরে দেখেছেন বাংলার রূপ। সামনে থেকে দেখেছেন হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক। জীবনের সেই সব অভিজ্ঞতা ফুটে উঠেছে তাঁর লেখনীর মধ্য দিয়ে।
জমিদারি দেখভালের জন্য জলপথে যেতে যেতেই রবীন্দ্রনাথ লিখে ফেলেন-
“অঞ্জনা-নদী-তীরে চন্দনী গাঁয়ে
পোড়ো মন্দিরখানা গঞ্জের বাঁয়ে
জীর্ণ ফাটল-ধরা— এক কোণে তারি
অন্ধ নিয়েছে বাসা কুঞ্জবিহারী।”
শোনা যায় এই নদী পথ ধরে যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাচ্ছিলেন, তখন কিছুটা থমকে গিয়েছিলেন এখানে। তার চোখের সামনে ধরা দিয়েছিল মন্দির খানি। বড় হাট বসত এই নদীর ধারে। সাধারণ মানুষের কোলাহলে চন্দনদহ ছিল জমজমাট। নিজের চোখে সেই ছবি দেখেছিলেন কবিগুরু। পরে তার কলমে ফুটে উঠেছিল এই কবিতা। কবি লিখেছিলেন,
“আশ্বিনে হাট বসে ভারী ধুম ক’রে,
মহাজনি নৌকায় ঘাট যায় ভ’রে;
হাঁকাহাঁকি ঠেলাঠেলি, মহা শোরগোল,
পশ্চিমি মাল্লারা বাজায় মাদোল।
বোঝা নিয়ে মন্থর চলে গোরুগাড়ি,
চাকাগুলো ক্রন্দন করে ডাক ছাড়ি।”
জমিদারি দেখাশোনার জন্যে রবীন্দ্রনাথ প্রথম পতিসর আসেন ১৮৯১ সালে। ১৯৩৭ সালে শেষবার সেখানে গিয়েছিলে। ১৯২১ সাল থেকে কালীগ্রাম পরগণারই জমিদার ছিলেন এই ঠাকুর পরিবার। ‘চৈতালি’র ভূমিকায় তিনি লিখেছেন,
“পতিসরের নাগর নদী নিতান্তই গ্রাম্য। অলসতার পরিসর, মন্থর তার স্রোত। তার এক তীরে দরিদ্র লোকালয়, গোয়ালঘর, ধানের মরাই, বিচালির স্তুপ, অন্য তীরে বিস্তীর্ণ ফসল-কাটা শস্যক্ষেত ধূ ধূ করছে। কোনো এক গ্রীষ্মকালে আমি এখানে বোট বেঁধে কাটিয়েছি। দুঃসহ গরম। মন দিয়ে বই পড়বার মতো অবস্থা নয়, বোটের জানলা বন্ধ করে খড়খড়ি খুলে সেই ফাঁকে দেখছি বাইরের দিকে চেয়ে। মনটা আমার ক্যামেরার চোখ দিয়ে ছোট ছোট ছবির ছায়াছাপ দিচ্ছে অন্তরে। অল্প পরিধির মধ্যে দেখছি বলেই তা স্পষ্ট দেখছি।”