ad
ad

Breaking News

Pratul Mukhopadhyay

মানুষের জন্য ডিঙি বাওয়া যিনি শেখালেন: বাঙালিয়ানার ‘মাহিকান’কে কুর্নিশ

তেলেনিপাড়ায় ভিখারি পাসওয়ান খুন হয়েছে, তার প্রতিবাদে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র সংসদের আয়োজনে এক বাংলা গানের অনুষ্ঠানে প্রতুল মুখোপাধ্যায় এলেন।

The one who taught people how to build dinghies: Kudos to Bangaliana's 'Mahikaan'

চিত্র: সংগৃহীত

Bangla Jago Desk: সুমন ভট্টাচার্য: “বাংলা আমার দৃপ্ত স্লোগান, তৃপ্ত শেষ চুমুক” প্রেসিডেন্সি কলেজের মাঠে প্রথম যেদিন প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের, আমাদের ‘প্রতুলদা’র কণ্ঠে এই গান শুনেছিলাম, তখনও সম্ভবত বাবরি মসজিদ ভাঙেনি। তেলেনিপাড়ায় ভিখারি পাসওয়ান খুন হয়েছে, তার প্রতিবাদে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র সংসদের আয়োজনে এক বাংলা গানের অনুষ্ঠানে প্রতুল মুখোপাধ্যায় এলেন।

এলেন শব্দটা বলা বোধহয় ভুল, আমাদের জয় করে নিলেন। তখনও প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের প্রথম একক অ্যালবাম বেরোয়নি। কিন্তু বেরোবে-বেরোবে করছে। ততদিনে বাংলা গানে সুমন চট্টোপাধ্যায় ওরফে কবীর সুমন এসে গিয়েছেন। এবং সবাই বাংলা গানের অন্য ‘মহীরুহ’দের খুঁজছেন। প্রতুল মুখোপাধ্যায় ছিলেন তেমনই এক ‘মহীরুহ’।

আর শনিবার যখন এসএসকেএম থেকে ৮৩ বছরের শিল্পীর দেহ নিয়ে রবীন্দ্র সদনের দিকে আমরা যাচ্ছিলাম, তখনও মনে পড়ছিল গত এক বছর ধরে কী দৃপ্ত কণ্ঠে তিনি ওই গান এবং আরও কত গান আমাদের শুনিয়েছেন ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের অঙ্গ হিসেবে। ‘দেশ বাঁচাও গণমঞ্চ’ নামে একটি নাগরিক সংগঠন করতে গিয়ে গত এক বছরে বারবার নতুন করে প্রতুলদাকে চিনেছি। চিনেছি তাঁর অদম্য জেদকে, লড়াইয়ের স্পৃহাকে। এবং বাংলার প্রতি ভালবাসাকে। তাই সত্যি, শনিবার একটি ইতিহাস শেষ হয়ে গেল, যে ইতিহাস আমাদের গর্ব ভরে বলতে শিখিয়েছিল, “আমি বাংলায় গান গাই”।

প্রতুলদা কেমন গান গাইতেন, তাঁর গানের মূল গুণ কী ছিল এইসব বিষয় আলোচনা করার ধৃষ্টতা আমার নেই। কবীর সুমন তো সেই কবেই বলেছেন, “মানুষটা নিজেই আস্ত একটা গান!” এটা সত্যি কথা! প্রতুলদা মানেই গান এবং সবসময় কিছু না কিছু বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা। আমাদের গণমঞ্চের এক সদস্য, মুর্শিদাবাদের লোকসঙ্গীত শিল্পী নাজমুল হককে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “নাজমুল, তোমার নামের মানেটা জানো তো?” বলে কী সরল করে বুঝিয়ে দিলেন ‘নাজ্ম’ থেকে নাজমুল শব্দটি কীভাবে এসেছে!

এই যে ধর্ম, বর্ণ সব কিছুকে অতিক্রম করে গিয়ে প্রতুলদার মানুষের প্রতি ভালবাসা, সংস্কৃতির নির্মাণ…তার কি কোনও দ্বিতীয় বিকল্প আছে? শনিবার হাসপাতালে পৌঁছনোর পর থেকে ফোনে, টেলিভিশনের স্ক্রিনে, মোবাইলে ভেসে আসা স্ক্রলে প্রতুলদা সম্পর্কে কতজন শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন দেখলাম।

কেউ তাঁকে ‘সমাজতান্ত্রিক’ বললেন, কেউ তাঁকে ‘বামপন্থী’ বললেন, কতরকমের অভিধা দেখলার। কিন্তু আমি যদি বলি তিনি শুধুই মমতাময়! বাঙালির প্রতি, মানুষের প্রতি এতটা ‘মমতা’ প্রতুলদা ছাড়া আর কার মধ্যে, কোন শিল্পীর মধ্যে দেখেছি? এবং হয়তো সেই কারণেই গত দেড় দশক ধরে রাজনৈতিক ভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তিনি, প্রতুল মুখোপাধ্যায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিলেন।

মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নয়, স্নেহের ছোট বোন হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার তাঁর স্বাস্থ্যের খবর নিয়েছেন, এসএসকেএম-এ তাঁর চিকিৎসার তদারকি করেছেন আর শেষযাত্রাতেও এসেছেন প্রিয় দাদাকে শ্রদ্ধা জানাতে। ঠিক তেমনটাই প্রতুলদাও গত এক বছর ধরে নিজের সমস্ত অসুস্থতাকে অতিক্রম করে দেশ বাঁচাও গণমঞ্চের রাজনৈতিক লড়াইতে, ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রতিরোধে শরিক থেকেছেন। প্রথম যেদিন দেশ বাঁচাও গণমঞ্চ পথ চলা শুরু করেছিল, সেদিনও দোলা সেন, পূর্ণেন্দু বসুদের অনুরোধে যে গানটা প্রতুলদা গেয়েছিলেন, সেটাই বেঁধে দিয়েছিল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সুর বা বলা ভাল হয়ে উঠেছিল প্রতিরোধের ‘এন্থেম’।

সেই প্রেসিডেন্সি কলেজের মাঠে ছাত্রবয়সে আমরা যখন অনেক কিছু স্বপ্ন দেখতাম, সেই সময় প্রতুলদার গান ছিল আমাদের স্বপ্ন দেখার সঙ্গী। ‘ডিঙা ভাসাও রে’ গানটি শুনতে শুনতে আপ্লুত চিত্তে বৃষ্টিতে, ঢেউতে নিজেদের নাও ভাসিয়ে দিয়েছি। সেই অনিশ্চিত নাও চলতে চলতে যে কোনওদিন আবার প্রতুলদার সঙ্গেই এক মঞ্চে এসে ধাক্কা খাবে, তা কে-ই বা জানত? কিন্তু ওই যে বললাম, মানুষের প্রতি ভালবাসা! আর মানুষের ভাল করার রাজনীতির প্রতি ‘কমিটমেন্ট’ প্রতুলদাকে আমাদের ‘সঙ্গী’ করে দিল।

কোথায় না গিয়েছেন প্রতুলদা? রাস্তার মোড়ের মঞ্চ থেকে হলের ভিতর, সব জায়গাতে প্রতুলদার গান ছিল প্রতিবাদের, প্রতিরোধের স্বর। বাংলার মানুষের নিজের কথা বলার চেষ্টা, এমনকী প্রসূন ভৌমিকের কবিতাকে অবলম্বন করে প্রতুলদা আমাদের জন্য একটা গান গেয়ে ফেললেন, যে গানটি হয়ে দাঁড়াল ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের অন্যতম থিম মিউজিক। এখানেই প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সার্থকতা। প্রায় গত চার দশক ধরে তিনি রাজনীতির এবং সমাজের সুরটা বেঁধে দিয়েছেন। এত স্পষ্ট উচ্চারণে, এত উচ্চকিত স্বরে আর কেউ বোধহয় বাঙালির হৃদয়ের কথা বলেনি।

‘‘আমি বাংলায় গান গাই” যদি একটা গোটা জাতির জন্য গর্বের ধন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, “ডিঙা ভাসাও রে” ছিল অনিশ্চিতকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষুরধার হাতিয়ার। গত চার দশকে বাংলার রাজনৈতিক জীবনে, সামাজিক জীবনে যত পালাবদল হয়েছে, তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান। এবং প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গানকে আপনি কোনও নির্দিষ্ট গণ্ডিতে বাঁধতে পারবেন না।

কিছু দিন আগে আমার স্ত্রী সৈয়দ তানভীর নাসরীনের ইচ্ছে হয়েছিল একটা “আমি বাংলায় গান গাই” লেখা শাড়ি পরে প্রতুলদার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলবে। প্রতুলদাকে সেই কথা বলাতেই এক গাল হাসলেন। এবং নিজেই সোৎসাহে বললেন, যে তোমরা বাংলা এবং বাঙালি নিয়ে একটা সংখ্যা করছ শুনলাম, আমি ওতে লেখা দেব।

আসলে বাংলা এবং বাঙালি, এই দুটো শব্দ নিয়ে প্রতুলদার যে আবেগ ছিল, সেটাই বোধহয় প্রতুলদার জীবনের অন্যতম চালিকাশক্তি ছিল। জাতীয় বাংলা সম্মেলনের সিদ্ধব্রত দাস শনিবার এসএসকেএম-এ দাঁড়িয়ে যখন অশ্রুসজল কণ্ঠে বলছিলেন, চার বছর আগে তাঁদের চলা যখন শুরু হয়, তখন প্রথম যে ‘সেলেব্রিটি’ বা বলা চলে সমাজ সচেতন মানুষ তাঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁর নাম প্রতুল মুখোপাধ্যায়।

যে কোনও অনুষ্ঠানে ২১শে ফেব্রুয়ারি হোক, রোকেয়া জন্মদিবস উদযাপন হোক, প্রতুলদা থাকতেন সর্বাগ্রে। প্রতুলদাকে সেইজন্য আমি কোনও নির্দিষ্ট ‘ব্র্যাকেট’ বা গণ্ডিতে বাঁধতে চাইব না। বরং বলব গত চার দশক ধরে তিনি বাঙালিকে ভালবাসা দিয়েছেন, এবং ভালবাসা পেয়েছেন, ভালবাসার সঙ্গে সঙ্গে পেয়েছেন অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। এই শ্রদ্ধার কারণ সম্ভবত রাজনীতিতে ‘বাঙালি অস্মিতা’ আসার আগে সংস্কৃতিতে বাঙালি অস্মিতার এমন বজ্রনির্ঘোষ ঘোষণা, মৃদু হাসি এবং ছোটখাটো চেহারা নিয়ে একজন বাঙালি করে দিতে পারে, তা কেউই আন্দাজ করতে পারেনি।

প্রতুল মুখোপাধ্যায় শুধু বাঙালির গানের ইতিহাসে নন, সেই কারণেই বাঙালির ইতিহাসে রয়ে যাবেন তাঁর বাঙালিয়ানার বজ্রনির্ঘোষ ঘোষণার জন্য। ওই যে তিনি বললেন ‘তৃপ্ত চুমুক’, সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির অন্তরাত্মা কেঁদে উঠল, বাঙালি নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করল।

প্রতুল মুখোপাধ্যায় সারাক্ষণ শুধু গান নিয়ে ভাবতেন। আমাদের আর দুই ‘সহযাত্রী’, শিল্পী অমিত কালি কিংবা নাজমুল হক বলছিলেন, যখনই তাঁদের সঙ্গে প্রতুল দা কোথাও গিয়েছেন, সারা যাত্রাপথে কিংবদন্তি শিল্পী শুধুই গান গাইতেন। গান ছাড়া অন্য কিছু বুঝতেন না। আর শব্দ নিয়ে মজার মজার খেলা। সবসময় হাসিখুশি সেই মানুষটিই যে রবীন্দ্র সদনে এইভাবে শুয়ে থাকবেন, তা কে জানত? শেষ শয্যায় প্রতুলদাকে দেখাটা তাই বাঙালির ‘লাস্ট মাহিকান’কে শ্রদ্ধা জানানোই হয়তো। যে ‘মাহিকান’কে অনেকদিন আমরা মনে রাখব সংস্কৃতির অঙ্গনে, ময়দানের যুদ্ধে এবং অবশ্যই নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার তীব্র লড়াইতে বুকে গানটুকু ভরে দেওয়ার জন্য।