গ্রাফিক্স: নিজস্ব
Bangla Jago Desk: কাজল ব্যানার্জি:
“ধরায় উঠেছে ফুটি শুভ্র প্রাণ গুলি,
নন্দনের এনেছে সম্বাদ,
ইহাদের কর আশীর্ব্বাদ।”
‘কড়ি ও কোমল’ কাব্যগ্রন্থে ‘আশীর্বাদ’ কবিতায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিশুদের সঠিক লালন-পালন, যত্ন ও তাদের বিকাশে পর্যাপ্ত মনোযোগ এবং গুরুত্বের বিষয়ে জনমানসে সচেতনতা সৃষ্টিতে এই আবেদন রেখেছিলেন এক শতাব্দী পূর্বে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সঠিক উন্নতি সাধন ছাড়া রাষ্ট্রকল্যাণ অসম্ভব। শিশুরাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। শিশুরা সুস্থ ও সবল না হলে দেশও শক্তিশালী হতে পারে না। কারণ যে কোনও সাফল্য, যে কোনও অনুশীলন বা যে কোনও চর্চার জন্য সর্বাগ্রে শিশুদের স্বাস্থ্য ভাল রাখাটা ভীষণ জরুরি।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক খাদ্য সূচকে আমাদের দেশের অবস্থানে শিশুদের স্বাস্থ্য নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ রয়েছে। তাই শিশুদের স্বাস্থ্যরক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। আমাদের জীবনের জীবনশৈলীর কিছু বদ-অভ্যাসকে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মে সংশোধন করার প্রয়োজন আমি সর্বদাই অনুভব করি। দীর্ঘদিন ধরে যে ভুল আমরা নিজেরা করে আসছি, সেই ভুলগুলি যেন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের শিশুদের মধ্যে না বর্তায় তা সুনিশ্চিত করতে হবে প্রতিটি অভিভাবককেই। তাই অতি স্বল্প পরিসরে শিশুদের স্বাস্থ্য রক্ষা ও সুঅভ্যাস গঠনের লক্ষ্যে কিছু বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করছি।
[আরও পড়ুন: Jharkhand: রাত পোহালেই ভোট, তার আগে ঝাড়খণ্ডে অ্যাকশনে ইডি!]
১) শিশুদের দাঁত ব্রাশ করার অভ্যাস সকালের পরিবর্তে রাতে শোয়ার আগে করতে হবে।
২) রাতে ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে খাওয়া খেয়ে নিতে হবে। জল খেতে হবে। খাওয়ার অন্তত ২০ মিনিট পর। প্রয়োজনে খাওয়ার আগে কিছুটা জল খাওয়া যেতেই পারে। শুতে হবে রাত সাড়ে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে। খেয়ে উঠেই সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়া যাবে না। শরীরে অনাবশ্যক মেদ জমার এটি একটি অন্যতম কারণ। এই বদঅভ্যাসের জন্য ফ্যাটি-লিভারের সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
৩) রাতে দাঁত ব্রাশ করার পর, আর জল খাওয়া যাবে না। ব্রাশ করতে হবে একেবারে শোয়ার আগে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই জল দিয়ে মুখ ভাল করে ধৌত করতে হবে। সকালে পুনরায় ব্রাশ করার দরকার নেই। বারংবার ব্রাশ করলে দাঁতের মাড়ির ক্ষতি হতে পারে।
৪) জল খেতে হবে একেবারে খালি পেটে। দাঁত মাজার পর কখনই জল খাওয়া চলবে না। মাজনের জীবানু-নাশক উপাদানগুলির কিছু অংশ মুখ থেকে ধৌত হয়ে পেটে চলে যায়। ফলে পেটের উপকারী জীবাণুগুলি মারা যায়। ফলস্বরূপ শিশুদের হজমের সমস্যা হতে পারে।
৫) পরিশুদ্ধ পানীয় জল পান করতে হবে। জল প্লাটিকের বোতলে রাখা যাবে না। ধাতব পাত্রে রাখতে হবে। তামার পাত্রে জল রাখতে পারলেই সর্বোত্তম। কিন্তু অর্থিক সমস্যা থাকলে মাটির পাত্রে রাখা যেতে পারে।
৬) শিশুদের সুস্থ থাকার জন্য এবং হাড় ও দাঁতের গঠন ভাল করার জন্য সূর্যালোক গায়ে লাগানোর ভীষণ দরকার। শরীরে ভিটামিন ডি-৩ সংশ্লেষণের জন্য বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে যে কোনও সময় অন্তত ২০ মিনিট পিঠে বিশেষত দুই-কাঁধে সূর্যালোক লাগাতে হবে। প্রতিদিন সম্ভব না হলে সপ্তাহে অন্তত ৪ দিন সূর্যালোক লাগানো আবশ্যক।
কিন্তু মাথায় রোদ্র লাগানো যাবে না। স্কুলে শারীর শিক্ষার ক্লাসগুলিও এই সময়ের মধ্যে রুটিনে রাখতে হবে। কন্যা সন্তানদের খালি গায়ে রাখতে হবে দিনের বেশির ভাগ সময়ে, যতবেশি দিন সম্ভব। কারণ পরবর্তী জীবনে কন্যা সন্তানদের গর্ভধারণে এবং ভ্রূণের পরিস্ফুটনে ভিটামিন-ডি৩-এর ভূমিকা আরও বেশি।
৭) শিশুদের নিয়মিত ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ টক জাতীয় ফল খাওয়াতে হবে নিয়মিত। রান্না করা টক বা চাটনি খাওয়ালে চলবে না। ভিটামিন-সি উত্তাপে নষ্ট হয়ে যায়। তাই কাঁচা অবস্থায় খেতে হবে। কমলালেবু, মুসুম্বি লেবু, অপেল, আঙুর, আমলকি, কামরাঙা, জলপাই, করমচা, টমেটো, লঙ্কা, কাঁচা আম, ধনেপাতা, পেয়ারা ইত্যাদি খেতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। দেখবেন শিশুদের ঠান্ডা লাগার প্রবণতা কমে যাবে। মুসুম্বি লেবুতে এলার্জি হলে খাওয়াবেন না।
8) সামুদ্রিক মাছ ও ছোট মাছ খেতে হবে কাঁটা চিবিয়ে। এছাড়া শিম, বরবটি, বিনস, মটরশুঁটি রাখতে হবে খাদ্য তালিকায়।
৯) শৈশব থেকেই সব্জি খাওয়ার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। সবুজ পাতা যুক্ত সব্জি খেতে হবে প্রতিদিন। দৃষ্টিশক্তি ভাল করতে গাজর খেতে হবে বেশি করে।
১০) রেড মিট ছোট বেলা থেকে এড়িয়ে যাওয়াই ভাল। পাড়ায় বাড়িতে পোষা দেশি মুরগিই ভাল। নিজের বাড়িতে রান্না করা খাসির মাংস দু-এক দিন খেলে ক্ষতি নেই। তবে নিমন্ত্রণ বাড়ির খাসির মাংস এক্কেবারে নয়। জ্যান্ত ছোট মাছই সবথেকে ভাল। চালানি রুই-কাতলা মাছ খাওয়াবেন না। মাছ দিনে সর্বাধিক চার পিস খেলেও ক্ষতি নেই।
১১) ফাস্ট ফুড, জ্যাঙ্কফুড, আজিনা মোটো দেওয়া দোকানের চাউমিন, মোগলাই বা কেমিক্যাল রঙ দেওয়া খাবার শিশুকে খাওয়াবেন না একেবারে। মোদ্দাকথা দোকানের খাবার না খাইয়ে বাড়িতে রান্না খাবার খাওয়ান।
[আরও পড়ুন: জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শুরু মেয়র্স কাপ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট]
১২) সরকারি নিয়ম মেনে টিকা দেবেন। মাঝেমধ্যেই কালমেঘ পাতার রস খাওয়াবেন। সকালে খালিপেটে কাঁচা হলুদ খাওয়াতে পারেন মাঝে মধ্যে।
১৩) পানীয় জল খাওয়াবেন পর্যাপ্ত। রৌদ্র থেকে দৌড়ে এসেই জল খাওয়া যাবে না। শীতকালে নাকে জল টানাবেন জোর করেই। পটি পেলে শিশু যেন তা চেপে না রাখে। পটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পটি করলে শরীর ভাল থাকবে।
১৪) শিশু চলচ্চিত্র দেখান। কিন্তু টিভি-তে মায়ের সঙ্গে সিরিয়াল একেবারে নয়। কার্টুন ফ্লিম দিনে ৩০ মিনিটের বেশি নয়। স্মার্টফোন, মোবাইল শিশুর হাতের কাছ থেকে দূরে রাখুন। বাবা-মায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব যেন সন্তানের সামনে না আসে।
১৫) যোগ-ব্যায়াম, দৌড়-ঝাঁপ, ছুটোছুটি করতে দিন। খেলতে দিন। হাঁটান। সাঁতার শেখান সাবধানে। শরীর থেকে যেন ঘাম বের হয় প্রতিদিন। পড়াশুনার জন্য বেশি চাপ দেবে না। শিশুকে আনন্দে বড় হতে দিন। সেই সঙ্গে শিশুকে নৈতিকতার শিক্ষা দিন। নিজেদের সংশোধন সম্ভব না হলেও, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যেন আমাদের মতো অসৎ ও শৃঙ্খলাহীন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে আমাদেরই।
১৬) অপরের বাচ্চাকে নিজের সন্তানস্নেহে যত্ন করুন। অন্যের বাচ্চাটি ভাল ডাক্তার হলে, আপনার রোগশয্যায় একদিন আপনারই সু-চিকিৎসায় কাজে লাগবে ওই অন্যের সন্তানটি। অন্যের সন্তানগুলি ভাল হলে, তবেই আপনার নিজের সন্তানটি সু-সঙ্গ পাবে, বাঁচার জন্য একটা সুন্দর পৃথিবী পাবে।
যেহেতু শৈশবই শিশুর মেধা বিকাশের সময় তাই শিশুর জন্মের পর থেকে সঠিক যত্নই শিশুকে তথা দেশকে সমৃ্দ্ধির পথে নিয়ে যেতে পারে। অতএব, শুধু নিজের জন্য নয়, আমাদের ভাবনাটা হোক ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। তাৎক্ষণিক প্রাপ্তির মোহে আবিষ্ট হয়ে আমরা কখনওই যেন ভবিষ্যতের স্বার্থ লঙ্খন না করি সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে আমাদের। কারণ, আজ যারা শিশু, আগামীকাল তারাই দেশের কর্ণধার। এ প্রসঙ্গে বহুকাল আগেই গোলাম মোস্তফা সাহেব তাঁর ‘কিশোর’ কবিতায় লিখেছিলেন—‘ভবিষ্যতের লক্ষ আশা মোদের মাঝে সন্তরে/ ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।/ আকাশ-আলোর আমরা সুত/ নূত বাণীর অগ্রদূত/ কতই কি যে করবো মোরা-নাইকো তার অন্ত-রে।’
ইহলোকে আমাদের প্রত্যেকেরই সময় কিন্তু খুবই সীমিত। আমরা কেউই অমর নই। ‘জন্মিলে মরিতে হবে/ অমর কে কোথা কবে/ চিরস্থায়ী কবে নীর, হায় রে, জীবন-নদে?’– মাইকেলের একথাও তো কারও কাছে নতুন নয়। তাই ইহলোকে আমাদের সীমিত সময়ের এই জীবনের সবথেকে বড় সাফল্য এবং সার্থকতা কিন্তু সুন্দর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গঠনের মাঝেই নিহিত।
[আরও পড়ুন: Virat Kohli: কোহলির বন্দনায় অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যম]
তাই শেষ করবো কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের সেই বহুল সমাদৃত কবিতার পংতিগুলিকে স্মরণ করিয়েই-
‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তুপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব— তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি;
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’