Bangla jago Desk, ডক্টর সুজীব কর: কালের নিয়মে সবই পরিবর্তন হয়ে যায়। বহু প্রাচীনকাল থেকে আমাদের চিরাচরিত ভাবধারা ও চিন্তাভাবনার মধ্যেও ঠিক একইভাবে অনেক পরিবর্তন এসেছে এবং তারসঙ্গেসঙ্গে মানুষের নিত্যদিনের জীবন ও জীবিকার ধারণা সম্পর্কেও পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু পরিবেশ সচেতনতার বিষয়ে এই পরিবর্তন এখনও অধরা। আমরা আমাদের চিরাচরিত চিন্তাভাবনার মধ্যে কখনওই পরিবেশকে নিয়ে সেই ভাবে ভাবতে পারিনি, যেখানে পরিবেশ আমাদের এক অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে আমাদের জীবন ও জীবিকাকে প্রভাবিত করতে পারে। শুধু তাই নয়, পরিবেশ ছাড়া বাস্তব ক্ষেত্রে পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্ব নেই, এই বিষয়টিও আমরা ভাবতে পারিনি। যার ফলে দিনের পর দিন পরিবেশ আমাদের থেকে দূরে সরে গিয়েছে এবং এই সুযোগ নিয়ে একশ্রেণির সুযোগ সন্ধানী মানুষ পরিবেশকে ভুলিয়ে রেখে আমাদের অত্যাধুনিক উন্নয়নের জোয়ারে ভাসতে এমনভাবে সাহায্য করেছে, যার ফলেউন্নয়নের খোলনলচে পরা এক সমাজ ব্যবস্থা হয়তো বাস্তবে টিকে আছে। কিন্তু বাস্তবিক ক্ষেত্রে পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্ব দিনের পর দিন একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে। কোথাও যেন একটা অবচেতনার অক্টোপাস আমাদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। যেখানে সমাজ চেতনা নিয়ে ভাবনা তো দূর, পরিবেশ চেতনা নিয়ে ভাবনার কথা শুনলে মানুষ ব্যঙ্গ করে। অর্থাৎ আমাদের মনে হয় এই ধারণা জন্মে গিয়েছে যে পরিবেশ এমনই একটা উপাদান যাকে আমরা যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করতে পারি এবং এটা আমাদের একটি অধিকার যে আমরা পরিবেশকে যেমন খুশি ভাবে আমাদের কাজে লাগাতে পারব।
প্রকৃতির প্রত্যেকটি সম্পদ যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পরিবেশের অন্তর্গত এবং যে সম্পদগুলি আমাদের দৈনন্দিন অগ্রগতির জোয়ারে ভাসতে সাহায্য করে সেই প্রত্যেকটি সম্পদই নিপুন হাতে প্রকৃতি তৈরি করেছে, আমরা সেই সম্পদগুলিকে গুরুত্ব দিই এবং সেই সম্পদগুলিকে ভালবাসি। তার কারণ এই সম্পদগুলি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে প্রসারিত করবে। কিন্তু আমরা বাস্তবের ক্ষেত্রে যে প্রকৃতি ‘মা’ আমাদের তার নিপুণ হাতে এই পৃথিবীতে বাসযোগ্য করে তুলেছে এবং যে সমস্ত উপাদানগুলি আমাদের বেঁচে থাকার মূল রসদ, সেই সমস্ত উপাদানগুলিকে আমরা কখনও গুরুত্ব দিই না। বরং নির্বিচারে তাদের উপরে অত্যাচার করি এবং প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে– কাগজে কলমে শুনে আমরা দুশ্চিন্তা প্রকাশ করি। কিন্তু আবার ব্যবহারিক জীবনে তা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে প্রকৃতির ওপর নির্বিচারে অত্যাচার করি। তাই স্বাভাবিকভাবে আমাদের চেতনাগত ক্ষেত্রের পরিসর বা ব্যাপ্তি যদি বৃদ্ধি না পায় তাহলে প্রকৃতিকে আমরা কখনওই আমাদের করায়ত্ব করতে পারব না। কারণ প্রকৃতি সম্পর্কে অনুভূতি তৈরি না হলে, শুধুমাত্র বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি দিয়ে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে, প্রকৃতির ওপরে অত্যাচারই করা হয় কিন্তু প্রকৃতিকে প্রকৃত অর্থে আমাদের কল্যাণে ব্যবহার করার উপযোগী করে তোলা সম্ভব হয় না।
তাই স্বাভাবিকভাবে আজকের সমগ্র পৃথিবীতে মানবজাতির বিপর্যস্ততা বারবার চোখেআঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে কীভাবে প্রকৃতি আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, আর কীভাবেই বা আমরা প্রকৃতিকে আমাদের অনুকূলে নিয়ে এসে আমাদের বহমানতাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে পারি। কিন্তু কর্পোরেট বিশ্ব এবং রাজনৈতিক বেসাতিতে যারা ব্যস্ত, সেই সমস্ত মানুষ তাদের নিপুণ হাতে আমাদের জ্ঞানচক্ষুর উন্মেষকে আটকে রেখে প্রকৃতি সম্পর্কিত ভাবনার সামনে সুনিপুণভাবে কালো চাদরের আচ্ছাদন তৈরি করেছেন। যার ফলে শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র কেউই প্রকৃত ক্ষেত্রে প্রকৃতি ভাবনায় ভাবিত নয়। যে কারণে প্রতিমুহূর্তে প্রকৃতি যেন কোথাও তার সকরুণ নেত্রে আমাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছে। কিন্তু এই সাহায্যের হাত যখন আমরা বাড়িয়ে দিতে পারছি না, তখনপ্রকৃতিকে তার নিজস্ব পদ্ধতিতে সৃষ্টিরখড়্গ হাতে তুলে নিতে হচ্ছে। কারণ ধ্বংসের মধ্যে দিয়েই নতুন সৃষ্টির বীজ বপন করা প্রকৃতির এক চিরাচরিত পদ্ধতি।
আমরা উন্নততর বিশ্বের মানুষ প্রকৃতির এই ক্রন্দনকে অনুভব করতে পারছি না এবং অনুভব করার চেষ্টাও করছি না। তার কারণ অনুভব করতে গেলে সহজ উন্নয়নের যে মেকি ধারণা তা সম্পূর্ণভাবে ফেলে দিয়ে নতুন করে উন্নয়নের ভাবনায় ভাবিত হতে হবে, আমাদেরকে আরও বহু পথ এগোতে হবে। গবেষণায় নিত্যনৈমিত্তিক নতুন ভাবনাগুলিকে গুরুত্ব দিতে হবে, সেটা না দিয়ে চিরাচরিত উন্নয়নের যে মেকি ধারণা তাকে আঁকড়ে ধরে মানুষের চোখে পর্দা পরিয়ে উন্নয়নের ধারণাকে প্রকাশ করা অত্যন্ত সহজ। সেই পদ্ধতিতেই বর্তমানেও সমাজ ব্যবস্থায় এগিয়ে চলেছে। একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান ও উন্নততর প্রযুক্তি যেখানে মানুষকে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে নিয়ে যেতে পারছে, সেখানে পৃথিবীতে থেকে পৃথিবীকে সুস্থ রাখার উপযোগী প্রযুক্তি বা জ্ঞানের প্রয়োগ কেন এখনও সম্ভব হচ্ছে না? তা স্বাভাবিকভাবেই এক বড় প্রশ্নের উদ্রেক করে।
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের খুঁটিনাটি প্রত্যেকটি বিষয়েরসঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। কিন্তু এই সম্পর্ককে আমরা কখনও উপলব্ধি করতে পারি না। তার কারণ উপলব্ধি করতে গেলে আমাদের চিন্তাভাবনার জগৎকে আরও প্রসারিত করতে হবে এবং কোথাও হয়তো আমাদের মেকি উন্নয়নের ধারণা সীমিত হয়ে যাবে। যার ফলে যারা রাজনীতির পসরা সাজিয়ে রাজনীতির বেসাতি করেন তাদের কাছে এটা এক বড় সমস্যার সৃষ্টি করবে, কারণ তারা বলতে পারবেন না যে উন্নয়ন ঘটছে। একবার চোখ তুলে ভাবুন তো যেখানে উন্নয়ন ঘটেছে বড় বড় শহর তৈরি হয়েছে, ইমারত তৈরি হয়েছে, গাড়ি-ঘোড়া চলছে, ট্রেন চলছে, প্লেন চলছে কিন্তু মানুষ নেই। অর্থাৎ মানুষের ভবিষ্যতের চিন্তা ভাবনা না করেই যে উন্নয়ন অত্যন্ত দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে তা বাস্তবিক ক্ষেত্রে ভ্রান্তিতে পরিণত হবে। অর্থাৎ আমাদের প্রত্যেকটি কাজ কর্মেরসঙ্গে পরিবেশের চিন্তাভাবনার যদি যথোপযুক্ত প্রয়োগ না ঘটে তাহলে বাস্তবিক ক্ষেত্রে আমাদের সামনের দিনগুলি চির অন্ধকারে ডুবে যাবে। মানুষের বহমানতা বলে কিছু থাকবে না। বাস্তবিক ক্ষেত্রে প্রকৃতির ওপর হস্তক্ষেপ থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। কারণ প্রকৃতি আমাদের ‘মা’ সে তার আলো,বায়ু,জল দিয়ে পৃথিবীপৃষ্ঠের ওপর আমাদের বিচরণকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। সেই প্রকৃতিকে যদি আমরা নির্মম হাতে নষ্ট করে ফেলি তাহলে বাস্তবিক ক্ষেত্রে আমাদের বাসযোগ্য, ভারসাম্যযুক্ত পরিমণ্ডল হারিয়ে যাবে চিরতরে।
আসলে আমরা এখনও অজ্ঞ, আমরা অনেক বড়াই করি আমাদের জ্ঞানের প্রসার ঘটেছে বলে কিন্তু, বাস্তবিক ক্ষেত্রে প্রকৃত অনুগ জ্ঞান আমাদের এখনও বিকশিত হয়নি। আমরা প্রকৃতিকে সতেজ ও সঠিক রেখে কীভাবে মানুষকে সুস্থ জীবন দিতে পারি সেই জ্ঞান এখনওবিকশিত হয়নি। যে কারণে আমরা এখনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলে আমাদের বিপর্যস্ততা প্রকাশিত হয় এবং প্রস্ফুটিত হয়। অর্থাৎ প্রকৃতিকে দমন এবং পীড়নের মাধ্যমে প্রাকৃতিক শক্তিকে করায়ত্ব করার যে প্রচেষ্টা তা হয়তো কোনও কোনও অংশে আমরা অর্জন করেছি। কিন্তু, প্রকৃতিকে সুস্থ রেখে তার সৌন্দর্যকে স্পর্শ না করে কী করে উন্নয়ন ঘটানো যায় সেই সম্পর্কিত চেতনা ও জ্ঞানের বিকাশ এখনও আমাদের মধ্যে ঘটেনি। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রকৃতি যখন আমাদের তৈরি করা অব্যবস্থাকে ভারসাম্যে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে, তখনই সৃষ্টি হয় এক একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের এবং সেই দুর্যোগের সম্মুখীন হলে আমরা ত্রস্ত হই এবং সেখান থেকে পালিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করি। যে কারণে প্রকৃতির ভয়াল রূপ বারবার আমাদেরকে বিদ্ধ করে। আর আমরা এক অস্ফুট ক্রন্দন করতে থাকি যেন প্রকৃতি আমাদের থেকে সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে প্রকৃতি তার নিজস্ব ভারসাম্যকে ফিরে পেতে চাইছে। এবং সেই ভারসাম্য ফিরে পেতে গেলে আমাদের দীর্ঘদিনের করে আসা ভুল আবর্জনাগুলিকে দৃঢ়ভাবে সরিয়ে ফেলতে হবে। নতুবা আমাদের ভুল আরওবাড়তেবাড়তে পাহাড়ে পর্যবসিত হবে।
সুতরাং, এখান থেকে প্রকৃতি তার নিজের বাঁচার পদ্ধতি বাস্তবিক ক্ষেত্রে শুরু করে দিয়েছে তাই স্বাভাবিকভাবে আমাদের জীবন এবং জীবিকার যে বাস্তবিক ভারসাম্যতা তা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। কারণ আমরা কখনওই প্রকৃতির অনুরূপ করে আমাদের জীবন এবং জীবিকার পদ্ধতিকে সাজাতে পারিনি। ফলে আমাদের অগ্রগতির যে পথ আর প্রকৃতির সুস্থতার যে পথ তা কোথাও যেন একটা বিরূপতা সৃষ্টি করে এবং তার ফলেই আমরা ধীরে ধীরে বিপন্ন হয়ে পড়ছি। ঝড়, ভূমিকম্প, ভূমিধস, বন্যা ও খরা প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলি একের পর এক এগিয়ে আসছে এবং আমাদেরকে বিশেষত মানব জাতিকে সমস্যার সম্মুখীন করে তুলছে। এখান থেকে মুক্তি পাওয়ার যে পথ তা আমরা বহুদিন আগে হারিয়ে এসেছি। সেই পথে নতুন করে প্রবেশ করার জন্য আমাদের যা যা ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, তা নিতে গেলে সম্পূর্ণভাবে প্রকৃতির রূপকে অপরিবর্তিত রেখে উন্নয়ন চেতনায় ভাবিত হতে হবে। মানব সভ্যতার বিকাশের যে বহুমুখী প্রসারতা তাকে নিয়ন্ত্রণে এনে প্রকৃতি উপযোগী উন্নয়ন পদ্ধতিকে গড়ে তুলতে হবে।
বর্তমান আমরা অত্যন্তভয়ঙ্কর এক পথে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছি। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে বিশ্ব উষ্ণায়নের করাল থাবা, অপরদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক হাতছানি। তাই মানব সভ্যতা যে বিপন্ন তা আজ সহজে বলা যেতে পারে। শুধু তাই নয় মানুষের সৃষ্টি করা সম্পূর্ণ কৃত্রিম এই পরিমণ্ডল অত্যন্ত দ্রুত গতিতে তার ভারসাম্যকে হারিয়ে ফেলছে। চূড়ান্ত বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব একদিকে যেমন জলবায়ু পরিমণ্ডলকে প্রভাবিত করছে তেমনি একই সাথে প্রভূত প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে ও প্রভাবিত করছে। তীব্র দূষণের যন্ত্রণায় আজ আমরা জর্জরিত।
তাই স্বাভাবিকভাবে বলা যেতে পারে এই উষ্ণায়নের ব্যাপ্তি সমগ্র পৃথিবী জুড়ে জলচক্রের পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। এর প্রভাব স্বরূপ কোথাও অতিরিক্ত বৃষ্টি এবং তার ফলে বন্যা পরিস্থিতি, আবার কোথাও বা অনাবৃষ্টি এবং তার প্রভাবে বায়ুমণ্ডলীয় সহাবস্থান এসব কিছুই কোথাও যেন মানব সভ্যতাকে আঘাত করছে। এইভাবে ক্রমান্বয়ে উষ্ণতাগত বৃদ্ধি এবং তার প্রভাবে সুমেরু ও কুমেরু অঞ্চলের জমে থাকা বরফ গলে গিয়ে সমুদ্রের জলস্তরের উচ্চতা কত বৃদ্ধি, এই সব কিছুই বিশ্ব হিমায়ানের নির্দেশক। অর্থাৎ আমরা এমন এক পরিমণ্ডলের দিকে অগ্রসর হচ্ছি যা আমাদেরকে তীব্র উষ্ণতা থেকে চূড়ান্ত শীতলতার দিকে পৃথিবীকে নিয়ে চলেছে। যা বাস্তব ক্ষেত্রে ভূপৃষ্ঠের ওপর প্রাণের অস্তিত্বকে প্রায় বিপন্ন করতে চলেছে। আর অপরদিকে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে সভ্যতা এবং তারসঙ্গেসঙ্গে এগিয়ে চলেছে মানুষের জীবন-জীবিকা। তাই স্বাভাবিকভাবে বিশ্ব হিমায়ানই আমাদের সম্ভাব্য গন্তব্য। তাই স্বাভাবিকভাবে বলা যায় চূড়ান্ত হিময়নই বর্তমান শতাব্দীতে বসবাসকারী মানব গোষ্ঠীকে ধীরে ধীরে চির শীতলতার পথে ঠেলে দেবে, সমগ্র পৃথিবী মানবশূন্য হয়ে পড়বে অদূর ভবিষ্যতে।