সুমন ভট্টাচার্য: শুক্রবার ভোরে প্রথমে ইরানের উপর হামলা ইজরায়েলের এবং ইরানের একাধিক সেনাকর্তা, পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা (Trump Policy)! আর তার পালটা জবাব হিসেবে ইজরায়েলের উপর ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা গোটা পশ্চিম এশিয়াকে শুধুমাত্র উত্তপ্ত করে তোলেনি, এক রক্তাক্ত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছে। একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠছে, তা হলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঠিক কোন নীতি নিয়ে চলছেন?
[আরও পড়ুন: Kedarnath: কেদারনাথে ফের দুর্ঘটনা- তীর্থযাত্রীবাহী হেলিকপ্টার ভেঙে মৃত ৫]
তিনি যে নির্বাচনের আগে অর্থাৎ তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে বলেছিলেন যে, তিনি হোয়াইট হাউজে ফিরলে সব যুদ্ধকে থামিয়ে দেবেন, তেমন তো কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ হয়নি, পশ্চিম এশিয়ায় ইজরায়েলের সঙ্গে তার প্রতিবেশীদের সংঘাত নতুন মাত্রা নিয়েছে। এবং ইজরায়েল প্রাথমিকভাবে ইরানের রাজধানী তেহরানে সফলভাবে হামলা চালালেও ইরানও পালটা জবাব দিতে কসুর করেনি।
ইরানের হামলায় তেল আভিভ, জেরুজালেমে বহু মানুষ মারা গিয়েছে, বহু বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অর্থাৎ গোটা পশ্চিম এশিয়া জুড়েই রক্ত ঝরছে! তা হলে ডোনাল্ড ট্রাম্প কী চাইছেন? তিনি কি ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর প্ররোচনা মতো এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বেন এবং পশ্চিম এশিয়ায় ইরান বনাম মার্কিন সংঘাত হলে তা যে ভয়াবহ রূপ নেবে, রক্তাক্ত চেহারা নেবে তা বলাই বাহুল্য (Trump Policy)।
হতে পারে ইরান আমেরিকার থেকে সামরিক শক্তিতে অনেক পিছিয়ে। কিন্তু যুদ্ধ হলে ইরান যে ‘মরণ কামড়’ দেবে এবং সেই ‘মরণ কামড়’-এ যে পরমাণু প্রত্যাঘাতও হতে পারে, তা তেহরান ইতিমধ্যেই বুঝিয়ে দিয়েছে। তা হলে ডোনাল্ড ট্রাম্প কী করবেন? ডোনাল্ড ট্রাম্প কি ওমানে ইরানের সঙ্গে আলোচনা এবং পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে এগোবেন নাকি ইজরায়েলকে এইরকম যথেচ্ছাচার চালিয়ে যেতে দেবেন?
এখনও অবধি ডোনাল্ড ট্রাম্প, ‘মার্কিন মহাশক্তিধর প্রেসিডেন্ট’ যদি কোনও যুদ্ধ থামিয়ে থাকেন, তা হলে সেটা ভারত-পাকিস্তান সংঘাত (Trump Policy)। তাঁর টুইটারে দেওয়া বক্তব্য অনুযায়ী, তাঁর বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিতেই নয়াদিল্লি এবং ইসলামাবাদ নিজেদের মধ্যে অস্ত্র সংবরণ করে নিয়েছে। যদিও ভারতের শাসকদল বিজেপি এবং তার নেতারা এই ট্রাম্পের ধমকের কথা ঘোরতরভাবে অস্বীকার করেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদি যেভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে সুড়সুড় করে ডোনাল্ড ট্রামকে অনুসরণ করেন, তারপর অন্তত তিনি বড়াই করে বলতে পারবেন না, যে তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের শান্তি আলোচনা বা শান্তি ফেরানোর প্রস্তাবকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
এবং যেভাবে শেষ মুহূর্তে ডাক পেয়েও নরেন্দ্র মোদি কানাডায় জি৭ গোষ্ঠীর শীর্ষবৈঠকে যোগ দিতে যাচ্ছেন, তার থেকেও এটা পরিষ্কার, যে নয়াদিল্লির পক্ষে আমেরিকার ক্ষমতার বলয় বা আমেরিকার প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয় (Trump Policy)। তা হলে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত বন্ধ করা ছাড়া ডোনাল্ড ট্রাম্প পৃথিবীর আর কোন প্রান্তে যুদ্ধ বন্ধ করতে পারলেন? তাঁর বারণ সত্ত্বেও মস্কো কিংবা কিয়েভ এখনও পর্যন্ত যুদ্ধ বন্ধ করতে রাজি হয়নি। বরং জেলেনস্কি রাশিয়ার অভ্যন্তরে ঢুকে হামলা চালিয়ে রাশিয়ার রুশ বিমান বাহিনীকে একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছেন। আর ইজরায়েল? ইজরায়েল তো রোজ নতুন নতুন করে পশ্চিম এশিয়ায় সংঘাত তৈরি করছে।
প্যালেস্টাইনে মোটামুটিভাবে গণহত্যা চালানোর পর এবার ইজরায়েল সরাসরি ইরানকে আক্রমণ করেছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নেতানিয়াহু ইরানকে আক্রমণ করে আসলে এই যুদ্ধে আমেরিকাকে জড়িয়ে নিতে চাইছেন, যাতে এরপরে পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকার রণতরী, আমেরিকার সেনাবাহিনী তেহেরানের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। তার পরিণতি কী হতে পারে? পশ্চিম এশিয়ায় আর একটি রক্তাক্ত যুদ্ধ কি কোনও সুস্থ ভবিষ্যৎ বা শান্তির দীর্ঘমেয়াদি পথকে দেখায়?
মার্কিন আভ্যন্তরীণ রাজনীতি অনুযায়ী এত দিন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে মনে করা হতো তিনি ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ পলিসি নিয়ে চলছেন। ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ বা ‘মাগা’-ই তাঁর স্লোগান (Trump Policy)। সেই স্লোগান অনুযায়ী আমেরিকা গোটা বিশ্বে ‘দাদাগিরি’ করতে চায় না। কোথাও যুদ্ধে জড়াতে চায় না। অর্থাৎ গত দুই দশক ধরে আমেরিকার রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট বা ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্টরা যে ‘ভুল’ করেছেন, যে ‘ভুল’-এর কথা ডোনাল্ড ট্রাম্পই বারবার বলেছেন, সেই ‘ভুল’কে আর এবারে রিপাবলিকান কর্তৃত্ব এগিয়ে নিয়ে যেতে চান না। অর্থাৎ একসময় ইরাক, আফগানিস্তান সমস্ত কিছু আক্রমণ করেও শেষ পর্যন্ত সেখানে কোনও শান্তি স্থাপন করতে পারেনি মার্কিন বিদেশনীতি।
আফগানিস্তানে বরং ২০ বছরের ব্যবধানে তালিবানরাই আবার ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। ইরাকে যে সরকার রয়েছে, তাও তীব্র মার্কিন বিদ্বেষী। আর ডেমোক্র্যাট নেতৃত্বের রাজনৈতিক নীতির কারণে যে লিবিয়া বা সিরিয়াতে পালাবদল হয়েছে, তাতে আখেরে আমেরিকার কোনও লাভ হয়নি। লিবিয়া তিন টুকরো হয়ে গিয়েছে, সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের পরে যারা ক্ষমতায় এসেছে, তারা আইএস-এরই একটি পরিবর্ধিত এবং পরিমার্জিত সংস্করণ। অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যে লড়াইয়ের কথা মার্কিন বিদেশনীতি দীর্ঘদিন ধরে সোচ্চারে ঘোষণা করেছে, তাতে আখেরে কিছুই হয়নি। সিরিয়ার মতো একটি দেশে আলকায়দা থেকে বেরিয়ে আসা একটি গোষ্ঠী ক্ষমতায় বসেছে, আফগানিস্তানে তো সরাসরি তালিবানরা! আরও খারাপ অবস্থা আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশে। সেখানে হিলারি ক্লিন্টন, জো বাইডেনরা যে সরকারকে বসিয়ে গিয়েছেন, তা খোলাখুলি মুসলিম মৌলবাদীদের ইশারায় চলে এবং ‘বাঙালি সংস্কৃতি’র বাংলাদেশকে পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়।
এহেন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক ইরান-ইজরায়েল সংঘাত নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প কী ভাবছেন? এটা বোঝা গিয়েছে, যে ইরানে যে হামলা চালাতে চেয়েছে ইজরায়েল, সে বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট সম্যক অবগত ছিলেন। যদিও মার্কিন বিদেশ সচিব রুবিও বিবৃতিতে বলেছেন, ইরানের উপর ইজরায়েল হামলা চালিয়েছে একক ক্ষমতায় এবং একক সিদ্ধান্তে। এই হামলায় মার্কিন সেনাবাহিনী বা মার্কিন গুপ্তচর সংস্থাগুলি কোনওভাবেই জড়িত ছিল না। কিন্তু একই সময় পিকনিকে ব্যস্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প (Trump Policy) পরিষ্কার করে দিয়েছেন, যে তিনি এই হামলার কথা জানতেন।
ইরানের উপর হামলায় ইজরায়েল প্রাথমিকভাবে খুবই সফল হয়েছে, ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্তা এবং পরমাণু বিজ্ঞানীদের তারা হত্যা করতে পেরেছে। কিন্তু তার প্রত্যাঘাতে ইরানও যেভাবে ইজরায়েলের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে মিসাইল ছুড়েছে, তা শুধু ইজরায়েলের জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে দেয়নি, সেখানেও মৃত্যু মিছিলকে ডেকে এনেছে। তা হলে মোদ্দা কথা লাভ কী হল? ইজরায়েলও কি শান্তির পথে বা প্রগতির পথে এগোতে পারছে? আমেরিকার (Trump Policy) ভিতরেও ইতিমধ্যে এই আওয়াজ উঠে গিয়েছে। এমনকী অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতিক বা তাত্ত্বিকদের মধ্যেও, যে আমেরিকা আর ভুল নীতি নিয়ে এগোতে পারে না, তারা অন্ধভাবে ইজরায়েলকে সমর্থন করতে পারে না।
ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি রাজনীতির চাইতে ব্যবসা ভাল বোঝেন এবং ভেবেছিলেন, যে ইজরায়েল গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দিলে সেখানে তিনি সমুদ্র তীরবর্তী রিসর্ট বানাবেন, তিনি কি বুঝতে পারছেন রাজনীতি আর ব্যবসা একসঙ্গে চলতে পারে না? তিনি ব্যবসার কারণে, নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থে অনেক সময়ে যে সব দেশের প্রশাসকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিচ্ছেন, তাঁরা খোলাখুলি সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মে যুক্ত। সেটা যেমন মার্কিন (Trump Policy) স্বার্থের জন্য বিপজ্জনক, তেমনই তাঁর মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাকের সঙ্গেও খুব একটা যায় না। আরও বিপজ্জনক ঘটনা হতে পারে, এত দিন ধরে তিনি আমেরিকাকে যুদ্ধ থেকে দূরে রাখার যে কথা বলেছেন, যেটা দিয়ে তিনি নির্বাচন জিতেছেন, সেটায় যদি আমেরিকা আবার জড়িয়ে পড়ে! অর্থাৎ, পশ্চিম এশিয়ায় ইরানের সঙ্গে সংঘাত মানে তা দীর্ঘমেয়াদি চেহারা নিতে পারে।
FB POST: https://www.facebook.com/share/p/1C39sYPPB2/
ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রপুঞ্জে খোলাখুলি চিন ইরানের সমর্থনে দাঁড়িয়েছে। ইরানের বন্ধু উত্তর কোরিয়াও রয়েছে। যদি এই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে থাকে, তা হলে তা আর আঞ্চলিক যুদ্ধে সীমাবদ্ধ থাকবে না। সেটা যখন তখন বিশ্বযুদ্ধের চেহারা নিতে পারে! সেটা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত নীতি বা মার্কিন স্বার্থ কোনওটার সঙ্গেই খুব যায় না। তাই শনিবার সকালটা না ওয়াশিংটনের জন্য, না পশ্চিম এশিয়ার জন্য খুব সুখের সময়। ইজরায়েলকে নিবৃত্ত করে, ইজরায়েলকে তার অন্য দেশগুলির উপর হামলা চালানো থেকে বিরত করে ডোনাল্ড ট্রাম্প কি সত্যি সত্যি শান্তি ফেরাতে পারবেন? সেই দিকেই তাকিয়ে আছে গোটা বিশ্ব।