ad
ad

Breaking News

Education Policy

কেন্দ্রীয় শিক্ষা নীতি মানতে রাজ্য বাধ্য না হলে জনগণেরই লাভ

যেভাবে শিক্ষানীতিতে আরএসএসের আদর্শের অনুপ্রবেশ ঘটছিল, তা অবশ্যই চিন্তাজনক ছিল।

The people will benefit if the state is not forced to follow the central education policy

চিত্র: সংগৃহীত

সুমন ভট্টাচার্য: ভারতবর্ষ যে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং যে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে আমাদের সংবিধান প্রণেতারা গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তার বড় জয় হল সুপ্রিম কোর্টে। সুপ্রিম কোর্ট পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিল, যে কেন্দ্রের তৈরি শিক্ষানীতি মানতে রাজ্যগুলি বাধ্য নয়। সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশকে, দেশের বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলি যে বড় জয় হিসেবে দেখছে, তার কারণ কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে আসলে আরএসএস এবং বিজেপির সেই ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’, এই স্লোগানকেই আরএসএস এবং বিজেপি রাজ্যে রাজ্যে চালু করতে চাইছিল। দক্ষিণের রাজ্যগুলি, বিশেষত ডিএমকে শাসিত তামিলনাড়ু বারবার এই কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে।

রাজ্যপাল ইস্যুতে কেন্দ্রের সঙ্গে ডিএমকে সরকারের বিরোধ চরম জায়গায় গিয়েছে। তামিলনাড়ুর রাজ্যপাল টিএন রবি ডিএমকে সরকারের পাশ করা বিল আটকে রাখায় তামিলনাড়ু সরকার সেই বিষয়েও সুপ্রিম কোর্টে যায়। এবং সুপ্রিম কোর্টও ঐতিহাসিক রায় দেয় রাজ্যপালের এই ধরনের কাজকর্মের বিরুদ্ধে। কিন্তু এবার সুপ্রিম কোর্ট যেভাবে কেন্দ্রের শিক্ষানীতি রাজ্যগুলি মানতে বাধ্য নয় বলে জানিয়ে দিল, তা অবশ্যই তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব কিংবা কেরলের মতো বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলির জন্য বড় জয়। কারণ, যেভাবে শিক্ষানীতিতে আরএসএসের আদর্শের অনুপ্রবেশ ঘটছিল, তা অবশ্যই চিন্তাজনক ছিল।

আরএসএস যেভাবে আমাদের মগজকে ধোলাই করতে চায়, কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতি কার্যত তারই একটি ‘টুল’ বা হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছিল বলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির তাত্ত্বিক নেতারা অভিযোগ করছিলেন। এবার সুপ্রিম কোর্ট পরিষ্কারই রাজ্যগুলির স্বপক্ষে রায় দেওয়াতে পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু বা কেরলের মতো রাজ্যগুলির অনেকটাই সুবিধা হল।

এমনিতে বিজেপি ভারতবর্ষের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে বিশ্বাস করে না। বিজেপি বা আরএসএস যে দর্শনে বিশ্বাস করে, সেখানে একটি শক্তিশালী কেন্দ্র থাকবে এবং তার অনুগ্রহ পাওয়ার আশায় ছটফট করতে থাকা অনেকগুলি ছোট ছোট রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থাকবে। আরএসএস তাদের তাত্ত্বিক বিভিন্ন কর্মশালায় বা নিজেদের মুখপত্রে এই বিষয়ে বিভিন্ন নিবন্ধ ছেপেছে। সেই সূত্র ধরেই আরএসএস বর্তমানে যেভাবে রাজ্যপালদের মাধ্যমে রাজ্যগুলিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে, তা নিয়ে তামিলনাড়ু থেকে কেরল, তেলেঙ্গানা থেকে পাঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গ থেকে হিমাচল প্রদেশ— সমস্ত বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলিরই তীব্র প্রতিবাদ ছিল। আরও প্রতিবাদ ছিল কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে আমাদের উপরে জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া, বা আরএসএসের ঠিক করে দেওয়া পাঠ্যক্রম বা সিলেবাসকে চালু করার বিরুদ্ধে।

আরএসএস ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে পাঠ্যক্রম থেকে মুঘল আমল থেকে শুরু করে অনেক কিছুই বাদ দিয়ে দিয়েছে, যা আসলে শিক্ষার গৈরিকীকরণের একটা ‘ঘুরপথ’ বলেই সবাই মনে করে। এই যে সিলেবাস বদল বা এই যে শিক্ষানীতিকেই বদলে দিয়ে আমাদের মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা, সেটা আরএসএসের কাছে নতুন কোনও বিষয় নয়। যে-কোনও অতি দক্ষিণপন্থী সংগঠন যেভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে দখল করে মগজকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, আরএসএসও সেই পথেই হেঁটেছে। সেই জন্যেই তাদের বাছাই করা বুদ্ধিজীবী এবং তাত্ত্বিকদের দিয়ে এই কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতি তৈরি করা হয়েছিল। সেই সময়েই বিভিন্ন রাজ্য এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানালেও বিজেপি সরকার জোর করে এই ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসিকে পাশ করিয়ে শুধু নেয় না, তা রাজ্যে রাজ্যে বাধ্যতামূলক করে দেয়।

এবার সুপ্রিম কোর্ট রায় আসার পর অবশ্য রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু শুধু যে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন তা নয়, তিনি বলেছেন, যে পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের সরকার তাঁদের নিজেদের দর্শন এবং কার্যক্রম অনুযায়ী নিজেদের শিক্ষানীতি তৈরি করবেন। সেটা ভাল উদ্যোগ হবে, কারণ, তা হলে আরএসএস ও বিজেপি মেরুকরণের দর্শন, হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সুচিন্তিতভাবে পাঠ্যক্রম তৈরি করা যাবে। আমাদের মনে রাখতে হবে রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রগুলিতে এমনিতেই যথেষ্ট সংকট চলছে কেন্দ্রের চাপিয়ে দেওয়া রাজ্যপালের কারণে।

পশ্চিমবঙ্গে ৩৬টি মতো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। তার মধ্যে ১৯টির জন্য রাজ্যপাল উপাচার্যের নাম ঘোষণা করে দিলেও ১৭টির নাম এখনও বাকি রয়েছে। এই বিষয়ও প্রণিধানযোগ্য, যে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী যেখানে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করে সেই কমিটির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নামগুলির ব্যাপারে বাছাইয়ের তালিকা তৈরি করা হয়েছে এবং তারপরে সেই বাছাই-তালিকা থেকে মুখ্যমন্ত্রী বেছে নিয়ে নাম রাজ্যপালের কাছে পাঠিয়েছেন। কিন্তু তারপরেও কীভাবে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস এভাবে উপাচার্যদের নাম আটকে রাখেন, তা গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। কারণ, রাজ্যের যে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এখনও স্থায়ী উপাচার্য নেই, সেখানে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক বিশৃঙ্খলা বা গণ্ডগোলের চিত্র মাঝেমধ্যেই উঠে আসছে।

যেমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন অধ্যাপিকার ক্লাসরুমে ছাত্রকে বিয়ে করার ভিডিও ভাইরাল হওয়া নিয়ে তুমুল আলোড়ন হয়েছিল। পরে সেই অধ্যাপিকা চাকরি ছেড়ে দিলেও সেই সময় শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আসলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্থায়ী উপাচার্য না থাকায়। সুপ্রিম কোর্ট বারবার রাজ্যপালকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উপাচার্যদের নাম চূড়ান্ত করে ফেলতে নির্দেশ দিলেও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস তাঁর কালো চশমা বা গগল্‌স এঁটে ঘুরে বেড়াতে এত ব্যস্ত থাকেন, যে এখনও অবধি ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যদের নাম ঘোষণা করতে পারেননি।

সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের পর একদিকে যেমন রাজ্যের নিজস্ব শিক্ষানীতি তৈরির জন্য রাজ্যের শিক্ষা দফতর ঝাঁপাবে, তেমনই অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টে আবারও উল্লেখ করতে হবে, যে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যপাল কীভাবে শিক্ষাক্ষেত্রের পরিবেশ নষ্ট করছেন, অর্থাৎ তাঁকে বারবার বলা সত্ত্বেও এমনকী সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়ে দেওয়ার পরেও কীভাবে তিনি উপাচার্যদের নামের তালিকাকে আটকে রাখছেন। কীভাবে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর বেছে দেওয়া নামের তালিকাকে অস্বীকার করে নিজের মতামত বা নিজের হাতের পুতুলদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বসাতে চাইছেন? এই কথাগুলি যদি মানুষের কাছে যায়, তা হলে অবশ্যই মানুষ বুঝতে পারবে, যে বিজেপি কীভাবে শিক্ষাক্ষেত্রকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, এবং কেন বারবার বিভিন্ন রাজ্যকে সুপ্রিম কোর্টে ছুটতে হচ্ছে সেই রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থাকে বাঁচানোর জন্য! পশ্চিমবঙ্গও তার কোনও ব্যতিক্রম নয়। পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থাকে দখল করা এবং তা গেরুয়াকরণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপি বা আরএসএস দীর্ঘদিন ধরে সচেষ্ট।

কেন্দ্র এবং রাজ্যের অর্থে গড়ে ওঠা মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, যাকে জনপ্রিয় ভাষায় ‘ম্যাকাইয়াস’ বলা হয়, সেই সল্টলেকের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানটি গত কয়েক বছর ধরেই কার্যত আরএসএস-এর আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এমনকি আরএসএস-এর বিভিন্ন পদাধিকারীরাও এসে সেখানে সভা করেন এবং রাজ্য সরকারের নিন্দে-মন্দ করেন। সুখের কথা, এবারে যেভাবে সুপ্রিম কোর্ট বোঝাল, যে রাজ্যের শিক্ষা কোন নীতি বা কোন পথ ধরে চলবে, সেটা ঠিক করার অধিকার রাজ্য সরকারেরই, তারপরে অন্তত এই বিভিন্নভাবে রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রকে ধ্বংস করে দেওয়ার বিজেপির চক্রান্ত ব্যর্থ হবে।

বিজেপি যে শিক্ষার গৈরিকীকরণ বা শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ অর্থাৎ পাবলিক ইউনিভার্সিটিগুলিকে যদি কোনওভাবে বেচে প্রাইভেট বা বেসরকারি উদ্যোগের হাতে তুলে দেওয়া যায়, সেই বিষয়েই বিশেষ আগ্রহী, তা নিয়ে কোনও সন্ধেহ থাকার দরকার নেই। সেই কারণেই তারা শিক্ষাব্যবস্থাকে এত দুর্বল করছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ে যেভাবে তাদের ধাক্কা লাগল, তারপর কি আরএসএস বা বিজেপি বুঝবে? তারা কি বুঝতে পারবে যে কেন্দ্রের নীতিকে সর্বক্ষেত্রে অনুসরণ করার জন্য রাজ্যের কোনও বাধ্যবাধকতা নেই?