Bangla Jago Desk, রাজু পারালঃ গত ১৯ সেপ্টেম্বরই আমরা পেরিয়ে এলাম কিংবদন্তী রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী সুচিত্রা মিত্রের জন্মশতবর্ষ। রবীন্দ্রনাথের গানকে সর্বজনীন করে তুলতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। একজন শিল্পীকে স্মরণ করে শতবর্ষ পালন করা কম কথা নয়। তখনই তা সাড়ম্বরে পালনে করার উদ্যোগ নেওয়া হয় যখন তিনি প্রাণের শিল্পী হয়ে ওঠেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের এরকমই একজন কিংবদন্তী শিল্পী ছিলেন ‘সুচিত্রা মিত্র’। আধুনিক গানের রূপকার রবীন্দ্রনাথের ধারাকে সাধারণ শ্রোতার কাছে সহজভাবে পৌঁছে দিয়েছিলেন সুচিত্রা মিত্র। তাঁর গাওয়া গান প্রতিটি মানুষের গান হয়ে ওঠে। গানের মধ্যে দিয়ে তিনি মানুষের জীবনের সুখ দুঃখকে বোঝানার চেষ্টা করতেন, যা ছিল চিরন্তন ও আধুনিক।
রবীন্দ্রসঙ্গীতে নিবেদিত সুচিত্রা নিজেই বলতেন, ‘এ গানই আমার সঙ্গী, আমার সব চাওয়ার সমাপ্তি।’ শৈশব থেকেই সুচিত্রা মিত্র গান ও সাহিত্যের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। এই অনুপ্রেরণা তিনি পান বাবা সৌরীন্দ্রমোহনের কাছ থেকে। সৌরীন্দ্রমোহন ছিলেন একজন বিশিষ্ট লেখক ও অনুবাদক। অন্যদিকে তিনি একজন রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুরাগী। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে তাঁর ছিল অবাধ মেলামেশা। সেকারণে অবধারিত ভাবেই তাঁদের বাড়ি হয়ে উঠেছিল ঠাকুরবাড়ির সংস্কৃতি ধারায় স্নাত। বাড়িতে রবীন্দ্রচর্চা হত। পাশাপাশি চলত সঙ্গীতের চর্চা।
বাড়িতে আড্ডার সঙ্গে সঙ্গে চলত গানের রেওয়াজ। মা সুবর্ণলতা গাইতেন ‘সন্ধ্যা হল গো ও মা’। সুচিত্রা বিভোর হয়ে যেতেন সে সব গান শুনে। একসময় পঙ্কজকুমার মল্লিকের গান শুনে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার বিশেষ উৎসাহ জেগে ওঠে মনে। কলকাতার কলেজিয়েট স্কুলে পড়ার সময়েই গানের চর্চা শুরু করেন। সেখানকার দুই শিক্ষক অমিতা সেন ও অনাদিকুমার দস্তিদারের কাছে শুরু করেন গানের চর্চা। পরের দিকে সরকারি বৃত্তি পেয়ে শান্তিনিকেতনে সঙ্গীত ভবনের ছাত্রী হওয়ার সৌভাগ্য হয় তাঁর। কিন্তু ততদিনে কবি রবীন্দ্রনাথের তিরোধান হয়েছে। তাই কবির সাথে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হয়নি। সেই আক্ষেপ তিনি পরবর্তীকালে একাধিকবার করেছেন। দীর্ঘ পাঁচ বছর শান্তিনিকেতনে কাটান সুচিত্রা মিত্র। কেবল সঙ্গীত শিক্ষা নয়, সেখানে সব কিছুতেই মনে প্রাণে মিশিয়ে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রভাবনা। শান্তিনিকেতনে সুচিত্রা শিক্ষক হিসাবে পান ইন্দিরাদেবী
চৌধুরানি, শান্তিদেব ঘোষ ও শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে। শান্তিনিকেতনের স্মৃতি তাঁর স্মৃতিপটে ছিল অমলিন।
শান্তিনিকেতনের শিক্ষাই তিনি পরবর্তীকালে ‘রবিতীর্থে’ বিভিন্ন গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য পরিচালনার কাজে লাগিয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনের সঙ্গীত শিক্ষা শেষ করে একসময় তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন স্নাতক হবার জন্য। সেটা ১৯৪৫ সাল। ভর্তি হন কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজ। শুরু করেন বিএ পড়া। এখান থেকেই স্নাতক হন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাস করেন। কলেজে পড়ার সময় থেকেই আগ্রহ তৈরী হয় রাজনীতিতে। আজীবন বামপন্থার প্রতি বিশ্বাস রেখেছিলেন। জড়িয়ে পড়েছিলেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে। তাঁকে দেখা যেত কফি হাউস, ধর্মতলার বামপন্থী শিল্পী-সাহিত্যিকদের আড্ডায়, এমনকি মিছিলেও।
সলিল চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে গণনাট্য আন্দোলনের কর্ণধারদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সখ্যতা তৈরি হয়। পরিচয়ের বৃত্তে আসেন শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও হেমাঙ্গ বিশ্বাসরা। পরবর্তী জীবনে সুচিত্রা মিত্র সক্রিয় রাজনীতি ছেড়ে দেন। তবে তার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরটি অক্ষুন্ন ও অম্লান ছিল। জীবনের ওঠা পড়ার সঙ্গে আজীবন যুদ্ধ করেছেন সুচিত্রা মিত্র । কখনো আপোষ করেননি। অবশ্যই তাঁর যুদ্ধের হাতিয়ার ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত। দীর্ঘকাল তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত বিভাগের প্রধান ছিলেন। সঙ্গীত বিষয়ে নিজের কিছু গ্রন্থও প্রকাশ করেছিলেন সুচিত্রা মিত্র। শেষ জীবনে তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের তথ্যকোষ রচনার কাজে নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ চলাকালীন তাঁর দৃপ্ত কণ্ঠে গাওয়া রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি বিশেষ অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল তাঁকে। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় সুচিত্রা মিত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার স্কুল ‘রবিতীর্থ’। এটা প্রতিষ্ঠা করতে এগিয়ে আসেন দ্বিজেন চৌধুরি। সুচিত্রা মিত্রের কথায়, রবীন্দ্রগান যে শুধু ড্রয়িং রুমে বসে গাওয়ার নয়, এই গানকে মিলিয়ে দিতে হবে জীবনধারায়, সেই আদর্শে আমরা বড় যত্নে, বড় ভালোবাসায় ‘রবিতীর্থ’কে লালন করে এসেছি। ‘সুচিত্রা মিত্র আজ আমাদের মধ্যে না থাকলেও তাঁর আদর্শে, তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা নানা ভাবে কাজ করে চলেছেন আজও। রবীন্দ্রসঙ্গীতের এই প্রবাদপ্রতিম গায়িকা না ফেরার দেশে চলে যান ২০১১ সালের ৩ রা জানুয়ারি।