চিত্রঃ সংগৃহীত
বিশ্বজিৎ বৈদ্য (বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক): একবিংশ শতাব্দীর নগরায়ন এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে— যেখানে শহর কেবল বসবাসের স্থান নয়, বরং প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও প্রশাসনের এক সুসংহত ক্ষেত্র। ‘স্মার্ট সিটি’ ধারণা সেই সংহতির প্রতীক, যেখানে তথ্যপ্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডিজিটাল অবকাঠামো ব্যবহার করে নগরজীবনকে আরও কার্যকর ও আরামদায়ক করার প্রচেষ্টা চলে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ২০১৫ সালে ‘স্মার্ট সিটিজ মিশন’ ঘোষণা করেন, যার লক্ষ্য ছিল ১০০টি শহরকে আধুনিক, পরিচ্ছন্ন ও প্রযুক্তিনির্ভর নগর হিসেবে গড়ে তোলা। তবে এই ‘স্মার্টনেস’-এর ভেতরে এক ধরনের মানবিক শূন্যতা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। নগর উন্নয়নের এই দৌড়ে প্রযুক্তির জয়গান যতটা জোরে বাজছে, মানবিক সংবেদন, সামাজিক সমতা ও পরিবেশগত ভারসাম্য ততটাই নিঃশব্দে হারিয়ে যাচ্ছে। তাই আজ প্রয়োজন ‘স্মার্ট সিটি’র চেয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে ‘সেনসিটিভ সিটি’— এক এমন শহর, যা প্রযুক্তির সঙ্গে মানবতার মেলবন্ধন ঘটায় (Smart City vs Sensitive City)।
‘স্মার্ট সিটি’ শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল ১৯৯০-এর দশকে যখন ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন নগর প্রশাসন শহরের ডেটা-নির্ভর ব্যবস্থাপনা চালু করতে (হল্যান্ডস, ২০০৮)। ইউরোপীয় কমিশনের এক প্রতিবেদনে স্মার্ট সিটিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এমন এক নগর হিসেবে যেখানে নাগরিক ও সরকারি প্রতিষ্ঠান তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে আরও কার্যকর, পরিবেশবান্ধব ও অংশগ্রহণমূলক প্রশাসন গড়ে তোলে। মূলত স্মার্ট সিটির ছয়টি মূলস্তম্ভ ধরা হয়— ১. স্মার্ট গভর্ন্যান্স, ২. স্মার্ট ইকোনমি, ৩. স্মার্ট এনভায়রনমেন্ট, ৪. স্মার্ট মোবিলিটি, ৫. স্মার্ট লিভিং, ৬. স্মার্ট পিপল। এই ধারণা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকার দ্রুত নগরায়িত দেশগুলিতে, কারণ এটি একাধারে উন্নয়নের প্রতীক ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়।
ভারতের স্মার্ট সিটিস মিশন শুরু হয় ২৫ জুন ২০১৫-তে। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল— ‘শহরগুলিকে নাগরিক-বান্ধব ও টেকসই করে তোলা’। প্রতিটি শহরে বিশেষ উদ্দেশ্য যানবাহন গঠন করে স্থানীয় প্রশাসন ও বেসরকারি সংস্থার যৌথ বিনিয়োগের মাধ্যমে অবকাঠামো উন্নয়ন, পরিবহণ, জ্বালানি ব্যবস্থাপনা, বর্জ্য নিষ্পত্তি এবং ডিজিটাল গভর্ন্যান্সের উন্নতি করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। মিশনের আওতায় মোট ১০০টি শহর নির্বাচিত হয়, যার মধ্যে পুনে, ভুবনেশ্বর, ইন্দোর, আমেদাবাদ, কলকাতা, বারাণসী, চেন্নাই প্রভৃতি শহর গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি করেছে। অনেক ক্ষেত্রে নগর পুনর্গঠন ও ‘এরিয়া বেসড ডেভেলপমেন্ট’ মডেল নেওয়া হয়েছে, যেখানে নির্দিষ্ট এলাকায় আধুনিক অবকাঠামো গড়ে তোলা হয় অন্য অঞ্চলের তুলনায় দ্রুতগতিতে। তবে এখানেই তৈরি হয় এক ধরনের দ্বন্দ্ব। স্মার্ট সিটির প্রযুক্তিগত উন্নয়ন অনেক সময় সামাজিক অন্তর্ভুক্তির চেয়ে অবকাঠামোগত প্রদর্শনীর দিকে বেশি মনোযোগ দেয়। ফলে শহরের মধ্যেই তৈরি হয় এক নতুন ধরনের বৈষম্য— ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ ও ‘ইকনমিক গেটিফিকেশন’।
স্মার্ট সিটির প্রধান চালিকা শক্তি হল ডেটা— সেন্সর, সিসিটিভি, মোবাইল অ্যাপ ও আইওটি ডিভাইস থেকে সংগৃহীত বিপুল পরিমাণ তথ্য। এগুলো বিশ্লেষণ করে প্রশাসন শহরের যানবাহন, জ্বালানি, বর্জ্য, এমনকী নাগরিকের চলাচলও পর্যবেক্ষণ করতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই নজরদারির শহর কি সত্যিই নাগরিকবান্ধব? ডেটা-নির্ভর শাসন একদিকে দক্ষতা বাড়ালেও অন্যদিকে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও স্বাধীনতার প্রশ্ন তুলছে। গবেষকরা বলছেন, স্মার্ট সিটির এই ‘সাইবারনেটিক কন্ট্রোল’ মানুষকে পরিণত করছে এক ধরনের তথ্যগত পণ্যতে, যেখানে নাগরিকের মানবিক পরিচয় মুছে যায়। তা ছাড়া, ভারতের প্রেক্ষাপটে তথ্য-প্রযুক্তি পরিকাঠামো ও ইন্টারনেট অ্যাক্সেস এখনো অসম। গ্রামীণ ও নিম্ন-আয়ের নাগরিকদের বড় অংশ ডিজিটাল সেবার বাইরে থেকে যাচ্ছে। ফলে স্মার্ট সিটির সুফল সীমিত পরিসরে বন্দি থেকে যাচ্ছে (Smart City vs Sensitive City)।
ভারতে স্মার্ট সিটি প্রকল্পের বাস্তব চিত্র মিশ্র। অনেক শহরে রাস্তা, আলো, ক্যামেরা ও ওয়াই-ফাই জোন তৈরি হলেও নাগরিক সেবার মৌলিক কাঠামো— পানীয় জল, নিকাশি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, আবাসন ইত্যাদি এখনও অপ্রতুল।
এসসিএম প্রকল্পের গড় বিনিয়োগ অনুমান ছিল প্রায় ২ ট্রিলিয়ন টাকা, কিন্তু এর বড় অংশ অব্যবহৃত রয়ে গেছে বা প্রায়োগিক স্তরে দেরি হয়েছে। অনেক শহর আর্থিকভাবে এসপিভি পরিচালনায় অক্ষম, ফলে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ফাঁক বাড়ছে। শহরের উন্নয়ন প্রায়শই নির্দিষ্ট এলাকা বা শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ। ‘এরিয়া বেসড ডেভেলপমেন্ট’ মডেল অনেক সময় বস্তি বা অনানুষ্ঠানিক বসতি এলাকাকে উন্নয়নের বাইরে রাখে। স্মার্ট সিটির অবকাঠামো উন্নয়ন প্রায়শই সবুজ পরিসর, জলাশয় ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করছে। উদাহরণস্বরূপ, পুনে বা গুরগাঁওয়ের মতো শহরে দ্রুত নির্মাণ কার্যক্রমের ফলে স্থানীয় নদী ও জলাশয় দখল হয়েছে। প্রযুক্তিনির্ভর পরিকল্পনায় নাগরিকের অনুভূতি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে প্রায় উপেক্ষা করা হয়েছে। ফলে শহরগুলো কংক্রিটের বন তো বটে, কিন্তু আত্মাহীন। এই বাস্তবতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়— শহর শুধু স্মার্ট হওয়ার নয়, সেনসিটিভ হওয়ারও প্রয়োজন (Smart City vs Sensitive City)।
স্মার্ট সিটি প্রযুক্তিনির্ভর, কিন্তু সেনসিটিভ সিটি মানবিক। সেনসিটিভ সিটি ধারণা মূলত এমন এক শহরের প্রতীক যেখানে প্রযুক্তি ও তথ্যব্যবস্থার পাশাপাশি নাগরিকের অনুভূতি, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও সামাজিক ন্যায়কে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। একটি সেনসিটিভ শহর কেবল তথ্যভিত্তিক নয়, সহানুভূতি ও অংশগ্রহণভিত্তিক। এতে শহর পরিকল্পনায় গুরুত্ব পায়— সামাজিক ন্যায় ও অন্তর্ভুক্তি স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণ পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধী-বান্ধব নগর নকশা নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ।
গবেষক রিচার্ড সেনেট বলেছেন, আধুনিক শহরগুলো কৃত্রিম দক্ষতার চাপে ‘জীবন্ত মানবিক স্পন্দন’ হারাচ্ছে। সেনসিটিভ শহর সেই হারানো সংবেদন ফিরিয়ে আনে— যেখানে প্রযুক্তি মানবজীবনের সেবক, প্রভু নয়। স্মার্ট সিটি যদি হয় মেশিন ও অ্যালগরিদমের শহর, তবে সেনসিটিভ সিটি হবে মানুষের, প্রকৃতির ও সংস্কৃতির শহর।
(ক) সামাজিক ন্যায় ও অন্তর্ভুক্তি—
ভারতের শহরগুলিতে ৩০ শতাংশ নাগরিক অনানুষ্ঠানিক শ্রমের সঙ্গে যুক্ত এবং অনেকেই বস্তি বা অস্থায়ী আবাসে বসবাস করেন। কিন্তু স্মার্ট সিটি পরিকল্পনায় তাদের প্রায়ই ‘নন-স্মার্ট’ এলাকা হিসেবে দেখা হয়। সেনসিটিভ শহর এই ব্যবধান ভাঙতে চায়— যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার যেমন বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে উন্নয়নের কেন্দ্রে রাখা হয়।
(খ) সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণ—
অনেক স্মার্ট সিটি প্রকল্পে ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য ও স্থানীয় নান্দনিকতাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। সেনসিটিভ সিটি সেই ভুল সংশোধন করে। উদাহরণস্বরূপ, ভুবনেশ্বর স্মার্ট সিটি মিশনে ‘একমরা হেরিটেজ জোন’ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে— যা দেখায় প্রযুক্তি ও ঐতিহ্যের সহাবস্থান সম্ভব।
(গ) পরিবেশের অন্তর্ভুক্তি—
সেনসিটিভ সিটি পরিবেশকে কেবল সৌন্দর্যের অংশ নয়, জীবনধারার ভিত্তি হিসেবে দেখে। টেকসই শহর গঠনে প্রয়োজন সবুজ এলাকা, জলাভূমি, সৌরশক্তি, এবং বৃষ্টির জল সংরক্ষণ ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্তি।
নগর প্রশাসনের সবচেয়ে বড় শক্তি হল তার নাগরিক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, স্মার্ট সিটি প্রকল্পে সাধারণ নাগরিকের অংশগ্রহণ সীমিত থেকেছে। একাধিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, অধিকাংশ স্মার্ট সিটি প্রকল্পে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে উপরের স্তর থেকে, যেখানে সাধারণ মানুষের মতামত প্রায়ই উপেক্ষিত। সেনসিটিভ সিটি-র অন্যতম মূল নীতি হল বটম-আপ গভর্ন্যান্স— অর্থাৎ জনগণ থেকেই পরিকল্পনার সূচনা। নাগরিকেরা শহরের নীতি, বাজেট ও প্রকল্পের পর্যবেক্ষণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবেন। এটি কেবল গণতন্ত্রের বিকাশ নয়, উন্নয়নের টেকসই রূপও নিশ্চিত করে।
এক্ষেত্রে অংশগ্রহণমূলক জিআইএস বা ‘কমিউনিটি ম্যাপিং’-এর মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে নাগরিকরা নিজেরাই এলাকার সমস্যা ও সম্ভাবনা চিহ্নিত করতে পারেন। দিল্লি, ইন্দোর, এবং পুনে শহরে এই ধরনের উদ্যোগ শুরু হয়েছে, যা সেনসিটিভ সিটি ধারণার দৃষ্টান্ত। একবিংশ শতাব্দীর শহরগুলির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল— কীভাবে প্রযুক্তি, পরিবেশ ও মানবিকতার ভারসাম্য রক্ষা করা যায়। নিচে সেনসিটিভ সিটি গঠনের জন্য কিছু বাস্তবিক নীতিগত প্রস্তাব দেওয়া হল–(Smart City vs Sensitive City)
১. অন্তর্ভুক্তিমূলক নগর নীতি– শহর পরিকল্পনায় নিম্নবিত্ত, নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মতামতকে বাধ্যতামূলক অন্তর্ভুক্ত করা।
২. সবুজ পরিকাঠামো– সবুজ ছাদ, জলাধার পুনরুদ্ধার ও সাইকেল-পথ তৈরি করে শহরের কার্বন নির্গমন কমানো।
৩. ডিজিটাল সাক্ষরতা– ডিজিটাল শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নাগরিকদের স্মার্ট প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত করা, যাতে ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ কমে।
৪.অংশগ্রহণমূলক বাজেট– নাগরিকদের শহরের বাজেট নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া।
৫. সাংস্কৃতিক অঞ্চল নির্ধারণ– শহরের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক অঞ্চলকে সুরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করে উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা।
৬. নগর সহানুভূতি সূচক– শহরের সংবেদনশীলতা পরিমাপের জন্য নতুন সূচক তৈরি করা, যেখানে প্রযুক্তি নয় বরং মানুষের জীবনমান ও সুখ সূচককে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
এভাবে সেনসিটিভ শহর প্রযুক্তির শৃঙ্খলে আবদ্ধ না হয়ে, মানবিক ন্যায় ও সামাজিক ভারসাম্যের উপর দাঁড়ানো এক অন্তর্ভুক্তিমূলক শহর হয়ে উঠবে।
শহর কোনও যন্ত্র নয়— এ এক জীবন্ত সত্তা। তার হৃদস্পন্দন নাগরিকের জীবনে, তার আত্মা নিহিত সামাজিক সম্পর্ক ও পরিবেশের সঙ্গে মেলবন্ধনে। স্মার্ট সিটি প্রকল্প আমাদের শহরগুলোকে আধুনিকতার মুখ দিয়েছে, কিন্তু একইসঙ্গে মানবিক সংবেদন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। আজ যখন পৃথিবী জলবায়ু পরিবর্তন, নগর বৈষম্য ও সামাজিক অস্থিরতার মুখোমুখি, তখন এক নতুন নগরদর্শনের প্রয়োজন— যেখানে প্রযুক্তি হবে সহায়ক, কিন্তু মানুষ থাকবে কেন্দ্রস্থলে। সেই শহরই হবে সেনসিটিভ সিটি— এক এমন নগর, যা স্মার্টও, আবার সংবেদনশীলও। স্মার্টনেস আমাদের শহরকে চালিত করে, কিন্তু সেনসিটিভনেস সেটিকে মানবিক করে তোলে। এই দুইয়ের মিলনেই সম্ভব ভবিষ্যতের টেকসই, ন্যায়ভিত্তিক ও সুখী নগর সমাজ।