চিত্র: সংগৃহীত
Bangla Jago Desk: মধুবন চক্রবর্তী (লেখক: কবি, লেখিকা ও কণ্ঠশিল্পী):
‘বাসন্তী, হে ভুবনমোহিনী দিকপ্রান্তে,
বনবনান্তে, শ্যাম প্রান্তরে, আম্রছায়ে
সরোবরতীরে, নদীনীরে, নীলাকাশে,
মলয় বাতাসে, ব্যপিল অনন্ত তব মাধুরী…’
গানটির স্বরলিপিকার দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
দক্ষিণী রাগ ‘বসন্ত পঞ্চমের’ আধারে রচিত এই গানটি শান্তিনিকেতনেই রচিত হয়েছিল।
গানটি একদিকে প্রকৃতি পর্যায়ের, অন্যদিকে দক্ষিণী রাগে আধারিত। পাশাপাশি কবির মনের প্রকৃতির সঙ্গে ঋতুররাজ বসন্তের যে গভীর প্রেমের সম্পর্ক, সেটি প্রস্ফুটিত হয়েছে এই গানটির মধ্যে দিয়ে।
এরকম অসংখ্য গানের রচয়িতা স্বরলিপিকার দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, যার প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লেখিকা প্রবীণ আশ্রম কন্যা ও রবীন্দ্রস্নেহধন্য অমিতা সেন, তাঁদের সময়কালে বসন্ত উৎসবের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাদের সময়ে দীনদার (দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর) নেতৃত্বে আমরা খুব ভোরে বৈতালিক দল ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’ গান গাইতে গাইতে আশ্রমের প্রতিটি বাড়ির দুয়ারে পলাশ আর আবির রেখে আসতাম। সকালে এটাই ছিল বসন্ত উৎসবে আশ্রমের সবাইকে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাবার রীতি..’ অমিতা সেনের কথায় জানা যায়, দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর একটা বিরাট এসরাজ নিয়ে বসতেন। পাশে বসতেন ভীমরাও শাস্ত্রী। সবাই মেতে উঠতেন আনন্দ উৎসবে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বসতেন আচার্যের আসনে প্রবীণ শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে। আচার্যের সামনে থাকত আবিরের স্তূপ।
গান শেষ হতে না হতেই শুরু হয়ে যেত উৎসব। শান্তিনিকেতনে বসে বহু গান কবিতা একের পর এক রচনা করে গিয়েছেন কবি। আসলে এই বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ছিল অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। বলা যায় নীরবে, নির্জনে এক গোপন বোঝাপড়া। ছিল আদান প্রদানের সম্পর্ক। দু’জনেই দু’জনের মাধুর্যে বিভোর যেন। কত চেনা জানা, কত আন্তরিকতা। ঠিক আপনজনের মতো। কবির চোখ, হৃদয়, সব শিল্পসত্তা জুড়েই ছিল দুই বাংলার মনোমোহিনী রূপ। বিশ্বের যে প্রান্তেই গিয়েছেন, সেখানকার প্রকৃতির মধ্যে বাংলার প্রকৃতিকে খুঁজেছেন তিনি। পেয়েছেন গভীর আস্বাদ, প্রেরণা, ভালবাসা, অপরূপ সৌন্দর্যের মহিমা।
কবি সে কথা অবশ্য নিজেই বারবার প্রকাশ করেছেন। রাঢ়ের লাল মাটি, রুক্ষ, শ্যামলনদী অনুষঙ্গের প্রকৃতিতে কবির আত্মমুক্তি ঘটেছে বারংবার। শান্তিনিকেতনের লীলাভূমিতে তাই নির্মাণ করেছিলেন বিশ্ব প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের উৎসবের প্রাঙ্গণ। শান্তিনিকেতন ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘প্রাণের আনন্দ আত্মার শান্তি’।
এখানেও তিনি প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিয়েছেন। বহু সংখ্যক গান, প্রবন্ধ রচিত হয়েছে এই শান্তিনিকেতনে। ৯ অক্টোবর ১৯১৩ সালে বিদেশ থেকে ফিরে প্রাক্তন ছাত্র সৌমেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মনকে। কবি লিখছেন ‘প্রবাসের পালা শেষ করে আবার আমাদের সেই আশ্রমে এসে বসেছি। কত আরাম সে আর বলতে পারি না দেশ-বিদেশের সম্মান সংবর্ধনা তো অনেক পেয়েছি, কিন্তু এখানকার খোলা আকাশের এই নির্মল আলোকে প্রতিদিন যে অভিষেক হয় তার কাছে কিছুই লাগে না।’
গীতিমাল্যের পালা যখন জ্বলছে প্রমথ চৌধুরীকে তিনি লিখলেন, ‘অনেকদিন চাপা থেকে হঠাৎ এখানে এসেই (শান্তিনিকেতন) মনের আনন্দে গানের উৎসটি খুলে গেছে..’
আবার পরের চিঠিতে প্রমথ চৌধুরীকে কবি জানাচ্ছেন, ‘বোলপুরে আমার আসনটি এমন জমে গেছে যে এখান থেকে নড়তে আমার সাহস হয় না। এখানকার প্রকৃতির সঙ্গে কেবল আমার চোখের দেখার সম্বন্ধ নয়। একে আমার জীবনের সাধনা দিয়ে পেয়েছি। সেই জন্য এখানে আমি সকল তীর্থের ফল লাভ করি। সেই জন্য এখানেই পড়ে থাকি এবং পরে থেকেই আমার ভ্রমণের কাজ হয়।’
যে শান্তিনিকেতনের লাল মাটি, প্রকৃতি, নদী তাকে এতটাই টানতো, সেই মাটিতে তিনি যে দোল উৎসব করবেন সেটাই তো স্বাভাবিক।
রবীন্দ্রনাথ উৎসব উদ্ভাবনার দিক থেকেছিলেন এক কথায় অনন্য অসাধারণ এক ব্যক্তি এইসব উৎসবের একটা মৌলিক হল প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটানো অর্থাৎ সেতু রচনার আন্তরিক প্রয়াস দেখিয়েছিলেন তিনি শিক্ষার পঠন-পাঠন উৎসব আনন্দ সৃজন কল্পনার নান্দনিকতা সব মিলেমিশে এই শান্তিনিকেতনে গড়ে উঠেছিল এক অনন্য পরিমণ্ডল। তৈরি হয়েছিল উৎসবের প্রাঙ্গণ।
১৯০১ সালে মাত্র ৫ জন ছাত্রকে নিয়ে এক বৈদিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্য আশ্রম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কবি। এমন এক শান্তির পরিবেশ, শিক্ষার নিকেতন তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যেখানে আনন্দ পরিবেশের মধ্যে দিয়ে ছাত্র-ছাত্রী, কর্মী, শিক্ষক আশ্রমিকদের চিন্তাভাবনা সৌন্দর্যবোধ মানবিক চেতনা সবকিছুই জাগ্রত হয়ে উঠবে। আর তার সেই স্বপ্ন ধীরে ধীরে সার্থক হয়ে উঠেছিল। আশ্রম বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হওয়ার কিছুকাল পর থেকেই ঋতু উৎসবের প্রবর্তন হতে লাগল। বিভিন্ন ঋতুকে নিয়ে কবি ঋতু উৎসব তৈরি করতে লাগলেন আশ্রমিক ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা। এই বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক অনাবিল আনন্দের ধারার মধ্যে নিজেদেরকে অতিবাহিত করবেন, এটাই ছিল আসল উদ্দেশ্য।
ও বসন্ত দুই কবির প্রিয় ঋতু। শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব রচনা করলেন কবি। প্রাচীনকালের সেই দোল যাত্রাপালা দোল উৎসবকেই রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসবে রূপ দিলেন। কবি বসন্তের মধুমাস ফাল্গুনকে এক অন্য চেতনায় আমাদের অন্তরে স্থান করে দিয়েছেন। এই বসন্তেই রচিত হয়েছে যে গান, সে তো নবীন আনন্দেরই গান, যা উদ্দীপ্ত করে তোলে মানুষের হৃদয়কে। বসন্ত যেন বাউল হয়ে ধরা দিয়েছে আমাদের কাছে। কবি মনও বাউল হয়ে উঠেছে এই বসন্ত উৎসবকে ঘিরে। এই প্রকৃতিতে বসন্ত আসলেই, একের পর এক গান তিনি রচনা করতে থাকেন। বসন্ত পূর্ণিমাকে নিয়ে অসংখ্য নাটক, রচনা হয়েছে। বিভিন্ন গানে, কবিতায়, প্রবন্ধে, নাটকে এসেছে বসন্তের আগমনবার্তা। বেশ কয়েকটি পালাও তিনি রচনা করেছিলেন এই বসন্তের আগমনে।
পলাশ মানেই তো বসন্ত। বসন্ত মানেই শান্তিনিকেতন। বসন্ত উৎসবের সূচনা বলতে গেলে ঋতু উৎসব হিসেবেই সূচনা হয়েছিল। ১৯০৭ সালের কথা, তদানীন্তন ছাত্রাবাস প্রাককুটি (বর্তমান শমীন্দ্র পাঠাগার) এর সামনে থেকেই এই উৎসব শুরু হয়। কবিপুত্র শমীন্দ্রনাথ এই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। ধীরে ধীরে এই উৎসব বসন্ত উৎসবে রূপায়িত হয়। বসন্ত উৎসব পরিণত হয় সম্প্রীতির উৎসবে। তৈরি হয় সর্বজনীন মিলনের উৎসব। প্রকৃতির আরাধনায় আবিরের রঙে রঙে, শান্তিনিকেতন ঋতুরাজ বসন্তকে আন্তর্জাতিক ঋতুতে পরিণত করে। সম্ভবত ১৯২৫ সালে প্রথম বসন্ত উৎসব অনুষ্ঠিত হয় ছাব্বিশে ফাল্গুন বসন্ত উৎসবের আয়োজন হয়েছিল। সকালে পুরনো লাইব্রেরির দোতালায় কলাভবনের ঘরে বসন্ত উৎসব অনুষ্ঠিত হলো। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
‘রুদ্রবেশে কেমন খেলা
কালো মেঘের ভ্রুকুটি
সন্ধ্যাকাশের বক্ষ যে ওই
বজ্রবানে যায় টুটি…’
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষেরও সম্পর্ককে আরও নিবিড় ভাবে গড়ে তোলার জন্যই এই উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন। সেই সময় বসন্ত উৎসবের প্রস্তুতি বর্ণনা দেখা যায় প্রমথনাথ বিশীর লেখা ‘রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন’ বইটিতে। তিনি লিখেছেন, ‘সেবারে বসন্ত উৎসব খুব ধুম করিয়া হইবে স্থির হইল। রবীন্দ্রনাথ নূতন গানের পালা লিখিয়া গানের দলকে শিখাইয়া তুলিলেন। আমরা কুঞ্জের সভাস্থল আলপনা এবং আবিরে সজ্জিত হইল, আমের ডালে ডালে বাতির ব্যবস্থা হইল, সকলে পীতবর্ণের ধুতি ও শাড়ি পরিয়া প্রস্তুত হইয়া অপেক্ষা করিতে লাগিল পূব আকাশে পূর্ণ চন্দ্র উঠিলেই সভারম্ভ হইবে।’
১৯৪০ সালের ২৭ মার্চ রবীন্দ্রনাথ শেষবারের মতন বসন্ত উৎসবের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরেছিলেন। সিংহাসনে সেবার বসন্ত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল আর সেই অনুষ্ঠানে অস্পষ্ট কবিতা পাঠের মধ্যে দিয়ে বসন্তকে কবি আহ্বান জানিয়েছিলেন। এরপর প্রত্যেক বছরই অনুষ্ঠিত হয়েছে দোল উৎসব। শান্তিনিকেতনে বসন্ত মুগ্ধতার পরিবেশ তৈরি করে। যার শুরু,
‘ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল
স্থলে জলে বনতলে লাগলো যে দোল…’
বসন্ত উৎসবের ইতিহাসের ২০০৯ সালটি ছিল কালো দিন। সব অনুষ্ঠানের সে বছর বাতিল হয়ে গিয়েছিল পূর্বপল্লীর পৌষ মেলার মাঠে সে বছর অনুষ্ঠান বদল হয় তৈরি হয়েছিল নানান বিতর্ক, তারপর আবার অনুষ্ঠিত হয় আশ্রম মাঠে। ধীরে ধীরে মানুষের ভিড় বেড়েছে। সতর্ক হয়েছে প্রশাসন। নিরাপত্তার কারণে বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। তবু শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব আজও ম্লান হয়নি। ম্লান হবে না কখনও।