ad
ad

Breaking News

Rabindranath Tagore

রবীন্দ্রনাথ আজও আমাদের চিন্তায়, চেতনায়, মননে, সত্ত্বায়, অনুভবে…

তাঁর অনুপম সৃষ্টির রূপ-রস ও ভাব-নিবিড়তার অনুসঙ্গ পেতে হলে আমাদের সেই 'রবীন্দ্র তীর্থে' যাত্রা করতেই হবে। সেই তীর্থেই জানা যাবে গোটা ভারতকে।

Rabindranath Tagore is still in our thoughts, consciousness, mind, being, and feelings...

চিত্রঃ নিজস্ব গ্রাফিক্স

Bangla Jago Desk: মহম্মদ মফিজুল ইসলাম: কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এক বিস্ময়কর প্রতিভা। বিশ্বের বিস্ময়। খণ্ডকালের হয়েও তিনি সর্বকালের। বিশেষ দেশের হয়েও তিনি সর্বদেশের। তিনি বিশ্ববরেণ্য। তিনি স্বনামধন্য। তিনি এক উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক। বাংলা সাহিত্যের এক কালজয়ী স্রষ্টা।

তিনি দেশ ও জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক। তিনি সাধক। তিনি দার্শনিক। তিনি মনুষ্যত্বের চির-উন্নত-শির। তিনি ভারত আত্মার বিগ্রহ। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। তিনি সুপ্তিমগ্ন জাতির স্বপ্নভঙ্গের গান।

তিনি কেবল কবি শ্রেষ্ঠই নন, তিনি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ। মানব জীবনের এমন কোনও চিন্তা নেই, এমন কোনও ভাব নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি। তাঁর কাব্যে দেশ ও কালের চিরন্তন প্রতিফলন। সেখানে ব্যথাহতরা পাবেন ব্যথা বিজয়ের প্রেরণা। দার্শনিকরা পাবেন প্রকৃত সত্যের সন্ধান। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা পাবেন সঠিক পথের দিশা। মৃত্যুপথযাত্রীরা পাবেন মৃত্যুঞ্জয়ী সান্ত্বনা।

জীবনের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পগত সৌন্দর্যের চরম উৎকর্ষায় কবিগুরুর সাহিত্য, গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনি, প্রহসন, রূপক-নাটক এবং সংগীত আজও এক চিরন্তন কালের পথনির্দেশক হিসাবে উজ্জ্বলতম আলোক-বর্তিকার ন্যায় দণ্ডায়মান। ব্যঙ্গ-কৌতুক থেকে শুরু করে হাস্যরসাত্মক নাটিকা, রম্যরচনা, দিনলিপি, চিঠিপত্র, ধর্মোপদেশ, শিক্ষা ভাষাতত্ত্ব, ছন্দ, বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ, লোকসাহিত্য এক কথায় প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রে তিনি সার্থক পদচারণা করেছেন।

তাঁর ভ্রমণ কাহিনিতে সুমুদ্রিত তাঁর ইতিহাস চেতনা, সময় সচেতনতা, অতলান্ত প্রজ্ঞা, দৃষ্টি, বিশ্বচেতনা, মানব প্রীতি এবং রসবোধের উজ্জ্বল পরিচয়। জীবনের এমন কোনও দিক নেই যা তাঁর সাহিত্যে স্থান পায়নি। তাই যে যে বিষয়ে আগ্রহী হোন না কেন রবীন্দ্র সাহিত্য তার মনের খোরাক জোগায়।

শুধু কবি বা গীতিকার নন, ঔপন্যাসিক বা নাট্যকর নন, শিল্পী বা চিত্রকর নন দেশপ্রেমিক এবং মহান চিন্তানায়ক হিসেবেও কবিগুরুর অবদান আজও অসামান্য। প্রতিভার এমন বহুমুখীতা, জ্ঞানের এমন গভীরতা, এমন ব্যাপ্তি সত্যিই বিস্ময়ের। রবীন্দ্রনাথ আমাদের অহংকার। আমাদের অস্তিত্ব। আমাদের প্রেরণা। আমাদের সমৃদ্ধি।

তিনি এমনই এক কল্পপুরুষ যাঁর ভাবতরঙ্গে আমরা অবগাহন করি। তাঁর চিন্তাধারায় চিন্তা করি। তাঁর সুরে ও বাণীতে গান গাই। তাঁর ভাষায় কথা বলি। লিখি। এককথায়, আমরা রবীন্দ্রনাথে মরি। আমরা রবীন্দ্রনাথে বাঁচি।

ঠাকুর পরিবারের সৃজনশীল পরিমণ্ডলেই রবীন্দ্রনাথের কাব্য চর্চার হাতে খড়ি। বড়রা তাঁকে উৎসাহ দিতেন। বউঠান কাদম্বরী দেবী দিতেন প্রেরণা। সেই উৎসাহ আর প্রেরণার মেলবন্ধনে তেরো বছর বয়সে প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম কবিতা। ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায়।

তেরো থেকে আঠারো পর্যন্ত রচিত কবিতার ডালি নিয়ে প্রকাশিত হল ‘শৈশব সংগীত’। অবশ্য এরই মধ্যে লিখে ফেললেন ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’। এ ছিল উত্তরকালের কবি শ্রেষ্ঠের প্রস্তুতি পর্ব। এবার তাঁর সাহিত্য সাধনার নবপর্যায়। সৃষ্টির প্রাচুর্যে ভরে উঠল ‘সোনার তরী’। প্রেম, প্রকৃতি, সৌন্দর্য ও স্বদেশকে ঘিরে কবি ভাবনা হল উচ্ছ্বসিত। বাঁধনহারা। এরপর এই মহৎ প্রতিভার দীর্ঘ পথ-পরিক্রমা। লিখে শেষ করা যাবে না তাঁর সাহিত্য প্রতিভাকে।

এদিকে তাঁর প্রতিভার ছোঁয়া পেয়েই বাংলা সাহিত্যের সব বিভাগই নব উচ্ছ্বাসে প্রাণ ফিরে পেল। বৈভবে, প্রাচুর্যে উপচে পড়ল তাঁর সাহিত্য ভাণ্ডার। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ‘গীতাঞ্জলী’র জন্য তিনি পেলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘নোবেল পুরস্কার’। বাংলার কবি হলেন বিশ্বকবি। তাঁর বন্দনায় মেতে উঠল গোটা বিশ্বের মানুষ। তিনি এক ব্যতিক্রমী প্রতিভা। তিনি এক বিরল ব্যক্তিত্ব।

কবিগুরু আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি, চিত্রকলা, ভাষাতত্ত্ব, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, রাষ্ট্রীয় আদর্শ, শিক্ষা, অর্থনীতি, ধর্ম-বিজ্ঞান এবং চিন্তায় ও মননে এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছেন এ বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। কেবলমাত্র সংখ্যার বহুলতায় নয়, দৃষ্টিভঙ্গির অভিনবত্বতে ও প্রকাশ রীতির চারুত্বে কবিগুরুর প্রবন্ধ সাহিত্যও অতুলনীয়। শিক্ষা, ইতিহাস, রাজনীতি এবং সমাজনীতি বিষয়ক প্রবন্ধেও রাবীন্দ্রিক উদার মানসমুক্তি বারে বারে প্রকাশ পেয়েছে।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, যে কবি, যে সাহিত্যিক তাঁর কাব্য প্রতিভা, নাট্যনির্মাণ ক্ষমতা, দার্শনিক চিন্তাশক্তি, সার্বভৌমিক ধর্মানুভূতি বৈজ্ঞানিক কৌতূহল সবকিছু মিলিয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সব কবিকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন তার সম্পূর্ণ পরিচয় পেয়েছেন ক’জন বাঙালি?

নিরুদ্দেশ সৌন্দর্যের সোনা-ঝরা পথেই যে তাঁর অবাধ পরিক্রমা, তা নয়। সমকালীন বহু ঘটনাই তাঁর মনে ঝড় তুলেছে। তিনি রুখে দাঁড়িয়েছেন দুর্বলের প্রতি প্রবলের ঔদ্ধত্য ও মত্ত-বর্বরতার বিরুদ্ধে। তিনি সোচ্চার হয়েছেন বাংলার তরুণ বিপ্লবীদের উপর ইংরেজদের নিষ্ঠুর ও অমানবিক নীতির বিরুদ্ধেও।

রাজনীতির সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না ঠিকই কিন্তু তিনি মূঢ়-ম্লান-মূক-নতশির মানুষের মুখে বলিষ্ঠ প্রতিবাদের ভাষা দিয়ে, প্রেরণা দিয়ে, সাহস জুগিয়েছেন অকাতরে। স্বাধীনতা সংগ্রামে কবিতা, প্রবন্ধ ও সংগীতের মধ্যে দিয়ে তিনি জাতিকে মাতিয়ে তুলেছেন বারবার।

তিনি উদ্বুদ্ধ করেছেন জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে। জালিয়ানওয়ালাবাগের পাশবিক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ইংরেজদের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি ‘স্যর” তিনি ত্যাগ করেছেন নির্দ্বিধায়। এ তাঁর সদাজাগ্রত মানবতার সুপরিচয়।

রবীন্দ্রনাথের সংগীত সৃষ্টি তাঁর অনন্য প্রতিভার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দিক। তাঁর রচিত প্রায় দ্বি-সহস্রাধিক সংগীত অনুভূতি, শিল্পীত বাণী ও অনুপম সুরের এক অনবদ্য ত্রিবেণী সঙ্গম। তাঁর সংগীত সত্যিই বৈচিত্র্যপূর্ণ। চিত্রশুদ্ধিতে, কর্মপ্রেরণা জোগাতে, আত্মপোলব্ধিতে, দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ ভুলতে অথবা ঈশ্বরের নিকট আত্মসমর্পণে তাঁর সঙ্গীত আজও অদ্বিতীয়।

অতুলনীয়। তাঁর রচিত দু’টি গান দুটি পৃথক দেশের (ভারত ও বাংলাদেশের) জাতীয় সংগীত। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত আর নেই। সত্যি এ গর্ব বাঙালির। এ গর্ব ভারতীয়ের। এ গর্ব সকলের।

কবিগুরুর মহাপ্রয়াণের পর গঙ্গায় গড়িয়েছে অনেক জল। পরিবর্তিত হয়েছে ভারতীয় তথা বাঙালির সাংস্কৃতিক ধারা। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক আদর্শগত দ্বন্দ্বে জাতি আজ দিশাহারা। চিন্তায় ও মননেও পড়েছে পশ্চিমী প্রভাব প্রবল। প্রবল আর প্রকট হয়ে উঠেছে নবীন ও প্রবীণের দ্বন্দ্ব। হারিয়ে গিয়েছে মানবিক মূল্যবোধ।

কবিগুরু কিন্তু প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির যা শ্রেষ্ঠ তাকে অকপটে গ্রহণ করার কথা বলেছেন। উভয় সভ্যতার যা একান্ত অসত্য ও মানবিকতা বিরোধী তাকে বর্জন করার নির্দেশও দিয়েছেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতা একান্তভাবে পরস্পর বিরোধী নয়। উভয় সভ্যতার মেলবন্ধনেই পৃথিবীতে এক মহা জাতি গঠিত হবে– এটাই ছিল কবিগুরুর সারা জীবনব্যাপী সাধনার মূল মন্ত্র।

আজকে সারা ভারতে সাম্প্রদায়িকতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রবল ঢেউ ভারতীয় জীবন ও জাতীয় সংহতিকে নানাভাবে বিপন্ন করছে। বিপর্যস্ত করছে দেশের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনকে। ব্যাহত করছে দেশের অর্থনৈতিক প্রগতিকে। দিকে দিকে বেজে উঠেছে রক্তমাখা হিংস্র শ্বাপদের হুঙ্কার।

সর্বব্যাপী অসত্য, অন্যায়, ভ্রষ্টাচার, আদর্শবিচ্যুতি, অনৈক্য সংঘর্ষ, অবিশ্বাস ও রক্তপাত আমাদের জাতির জীবনকে অধঃপতনের নরককুণ্ডে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এমন দিনে রাবীন্দ্রিক আলোকে আমাদের আত্মসমীক্ষা ও আত্মশুদ্ধি একান্ত প্রয়োজন।

বৈদিক ঋষির অতলান্ত প্রজ্ঞা, বাল্মিকী-বেদব্যাস-কালিদাসের অনন্য কবি প্রতিভা এবং গ্যেটে-টলস্টয়ের সুগভীর সমাজ চেতনা রবীন্দ্র সৃষ্টি সম্ভারকে দিয়েছে লোকোত্তর দীপ্তি। রবীন্দ্রনাথ আধুনিক ভারতের নব তীর্থভূমি।

[আরও পড়ুন: জমি বিবাদে সংঘর্ষ, কোদালের কোপে গুরুতর আহত এক ব্যক্তি]

তাঁর অনুপম সৃষ্টির রূপ-রস ও ভাব-নিবিড়তার অনুসঙ্গ পেতে হলে আমাদের সেই ‘রবীন্দ্র তীর্থে’ যাত্রা করতেই হবে। সেই তীর্থেই জানা যাবে গোটা ভারতকে। আর অবশ্যই মনে রাখতে হবে, কবিগুরু একটু সুমহান দেশ ও জাতির শাশ্বত প্রতীক– চিরকালীন প্রতিনিধি। আজ দেশের এই সংকটময় সময়ে মানুষ যদি রবীন্দ্র চেতনায় পরিশোধিত করে নেয় নিজেকে, যদি বিশ্বের প্রতিটি মানুষ রবীন্দ্রনাথ বাণীর আদর্শে সর্বাত্মক মুক্তি ও মানব প্রগতির লক্ষ্যে এগিয়ে চলার শপথ নেয় আমৃত্যু, তা হলে আমাদের দেশ ও পৃথিবী সর্বপ্রকার ধ্বংস-বিভীষিকা, হিংসা, অসাম্য, অবক্ষয়ী মূল্যবোধ ও অশান্তির নরকগ্লানি থেকে পরিত্রাণ পাবে।

জীবন ও জীবনাতীতকে উপলব্ধি করার মর্ত্য-পৃথিবী ও মর্ত্য-মানবকে ভালবাসার, বিশ্ব ও বিশ্বমানবকে আপন করে নেওয়ার যে মন্ত্র আমরা কবিগুরুর কাছ থেকে পেয়েছি, তা যদি চিত্ত-বর্ণ-ধর্ম-গর্ব পৃথিবীবাসী জীবনের মূল মন্ত্র করে নিতে পারি, তা হলে যুদ্ধ-হত্যা-মৃত্যু-ভীত এই মর্ত্যালোকই চিরন্তন শান্তিনিকেতন হয়ে উঠবে। এই পৃথিবী হয়ে উঠবে মৈত্রী, অহিংসা ও প্রেমের অমরাবতী। এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।