ad
ad

Breaking News

West Bengal

খণ্ডিত বঙ্গের গর্বিত বাঙালি

রাজনীতি থেকে শুরু করে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে বাঙালির জয়জয়কার। শিক্ষা আর স্বাস্থ্য পরিষেবাতেও এগিয়ে বাংলা। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরোভাগে বাঙালি। এই রাজ্যের বাইরেও বাঙালিরা ছিলেন সুপ্রতিষ্ঠিত। ডাক্তারি, ওকালতি, চাকরি, সর্বত্র বাঙালির উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।

Proud Bengalis of divided Bengal

চিত্র : সংগৃহীত

Bangla Jago Desk: দীপঙ্কর চক্রবর্তী : বাঙালি হিসেবে আমি কেন গর্ববোধ করি বলার আগে একটু অতীত ইতিহাসের পাতাগুলো ঘেঁটে দেখা দরকার। কারণ, ইতিহাসের মার সবচেয়ে বেশি খেয়েছি আমরা বাঙালিরা। গরিমার অত্যুচ্চ শৃঙ্গ থেকে গড়িয়ে পড়েছি নীচে, আরও নীচে। তবু হার মানিনি। এখনও ভারতের যে কোনও রাজ্যে, পৃথিবীর যে কোনও দেশে বাঙালির উজ্জ্বল উপস্থিতি। এখনও আমরা অনন্য।

সেই কবে গোপাল কৃষ্ণ গোখলে বলে গিয়েছেন “হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে, ইন্ডিয়া থিঙ্কস টুমরো”… ব্যাস, বাঙালি সেটাকেই আঁকড়ে ধরে রইল। আসলে সত্যিই সেটা ছিল বাঙালির মাথা উঁচু করে থাকার যুগ। বেঙ্গল রেনেসাঁ বা বাঙালির নবজাগরণের দ্বিতীয় পর্ব। রাজনীতি থেকে শুরু করে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে বাঙালির জয়জয়কার। শিক্ষা আর স্বাস্থ্য পরিষেবাতেও এগিয়ে বাংলা। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরোভাগে বাঙালি। এই রাজ্যের বাইরেও বাঙালিরা ছিলেন সুপ্রতিষ্ঠিত। ডাক্তারি, ওকালতি, চাকরি, সর্বত্র বাঙালির উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।

তারপর ধীরে ধীরে বাঙালির গৌরব রবি অস্তাচলে ঢলে পড়েছে, অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, তবু কিন্তু আমরা আছি। যতই হোক, এখনও আমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি পছন্দ করি না, মোটামুটি পরমতসহিষ্ণু- সে খাওয়াদাওয়া, পোশাক, যাই হোক। বাঙালির দুর্গাপুজো যতটা ধর্মীয়, তার চেয়ে বেশি উৎসব, যেখানে সব ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে সবাই যোগ দিতে পারে। বাঙালির কাছে মা দুর্গা ঠিক দেবী নন, ঘরের মেয়ে। মেয়েকেও তো আমরা ‘মা’ বলেই ডাকি। এই মেয়ে প্রতি বছর শরৎকালে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি আসেন। দিন পাঁচেক থাকেন (ইদানিং অবশ্য সেটা মাসখানেকে দাঁড়িয়েছে) তখন প্রচুর আনন্দ, দেদার মজা। মেয়ে বাপের বাড়ি এলে যেমন হয় আর কি! আমাদের খাওয়া দাওয়াতেও তখন উৎসবের আমেজ। এই দেবীকে ঘরের মেয়ে হিসেবে দেখার ধারণাটাই ভিন রাজ্যের মানুষ বুঝতে পারে না।

থকে কী খাচ্ছে, খাবে, অন্যত্র গোমাতার সন্তানরা সেটা ঠিক করে দেয়। বাঙালিরা ওদের কাছে ঘেঁষতেই দেয় না। কে কী পোশাক পরছে, তাতে মেয়েদের শ্লীলতা রক্ষা হচ্ছে কিনা তা নিয়ে কয়েকটি রাজ্যের বাসিন্দাদের চোখে ঘুম নেই। বাংলার মানুষ এসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায় না। এখানে একটা ভালো সিনেমা বা নাটক এলে, ভালো বই বেরোলে তা নিয়ে লোকে আলোচনা করে, ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের খেলা নিয়ে চায়ের কাপে তুফান তোলে। এগুলো আমাদের গর্ব, এই সব নিয়েই আমরা বাঙালি।

একজন বাঙালি দার্শনিকের লেখায় পড়েছিলাম, নিজের পাড়ায় আমার পরিচয় পাড়ার লোক হিসেবে, পশ্চিমবঙ্গে পরিচয় যে শহর বা জেলার বাসিন্দা, তার নিরিখে, ভারতের অন্যত্র আমি বাঙালি, আর বিদেশে আমি প্রথমত ভারতীয় অবশ্যই, তার পরেই কিন্তু বলতে ভুলি না, আমি বাঙালি।

এই প্রসঙ্গে বিদেশের একটা ঘটনার কথা বলি। সেই সময় আমি কয়েক বছরের জন্য কাজে জার্মানিতে গিয়েছি। তখনও দুই জার্মানি এক হয়নি। পূর্ব আর পশ্চিম জার্মানির মধ্যে কাঁটা তারের

বেড়া, আত্মীয় বন্ধু সব এ পারে ও পারে আলাদা হয়ে রয়েছে। আমি কোলনে জার্মান রেডিও ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগে কাজ করি। একদিন একটা স্কুলে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল ছাত্রদের কাছে নিজের নিজের দেশের ভাষা নিয়ে কিছু বলার জন্য। অফিসের যে জার্মান ভদ্রলোক আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি আমাকে বললেন, “আপনি তো বাংলা বিভাগের, ওদের কাছে বলবেন আপনি বাংলাদেশি। ভারতীয় বললে, ওরা ভাববে আপনার ভাষা হিন্দি।”

শুনে আমার খুব হাসি পেল। ওঁকে বললাম, “আপনার জানায় গণ্ডগোল আছে। ভারতীয় মানেই হিন্দিভাষী নয়। ভারতের সংবিধান স্বীকৃত বাইশটি ভাষার মধ্যে হিন্দি একটি, বাংলাও তাই। সরকারি কাজের ভাষা দুটি, হিন্দি আর ইংরেজি।” এই পর্যন্ত শুনেই ভদ্রলোকের মুখ হাঁ!

বললাম, “ভারত একটা বিশাল দেশ, যেখানে বহু ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, সব মিলেমিশে আছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি ছাত্রদের বুঝিয়ে বলব। ওরা জানতে পারবে, আপনিও শুনবেন।”

আমার পালা এলে বললাম, “আমি এসেছি ভারত থেকে, তবে আমার মাতৃভাষা বাংলা, আমি বাঙালি। আসলে ভারতের স্বাধীনতার সময় ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়ে যায়। বঙ্গও দ্বিখণ্ডিত হয়ে এক অংশ পাকিস্তানে পড়ে, অন্য অংশ ভারতে থেকে যায়। তখন যা পূর্ব পাকিস্তান ছিল, পরে সেটাই স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়।

কিন্তু দুই বাংলার ভাষা এক, বাংলা। এই ব্যাপারটা ঠিক তোমাদের জার্মানির পূর্ব পশ্চিমে ভাগ হয়ে যাওয়ার মতো।”

এবার ছাত্ররা ঠিক বুঝতে পারল, কৌতূহলের বশে অনেক প্রশ্ন করল। বাঙালির খাওয়া দাওয়া, আচার আচরণ, সবই জানতে চায় ওরা। কিছু উত্তর দিতে দিতে সময় পার। আবার একদিন এসে গল্প করব বলে বিদায় নিলাম। ফেরার পথে গাড়িতে ডয়চে ভেলের ভদ্রলোক লাজুক হেসে বললেন, “সত্যিই এত কিছু জানতাম না। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।”

নিজের নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসা নিয়েও স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা যায়। মুশকিল হল, পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ মানুষই বাঙালিয়ানা বলতে ‘বাবু ও বিবি কালচার’ বোঝে। প্রতিদিন প্যান্ট শার্ট পরে থাকা বাঙালি পুরুষ বঙ্গীয় উৎসব অনুষ্ঠানে চোখে পড়ার মতো বিশেষ বেশ ধারণ করে। যদিও আজকাল অনেকেই ওসবের ধার ধারে না।

নিয়মমতো পুরুষদের পোশাক হতে হবে কোঁচা লুটোনো ধাক্কা পাড়ের ধুতি, গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি, কোলাপুরি চটি, ইত্যাদি। সুদূর মহারাষ্ট্রের এই চটি কীভাবে যে বাঙালি সাজের অঙ্গ হয়ে গেল কে জানে! মহিলাদের শাড়ি পরার নিয়মও আলাদা। সব মিলিয়ে রীতিমতো ভজখট, সামলাতে হিমশিম। এ যুগের মেয়েরা অনেকে সাধারণভাবে শাড়ি পরলেও ছেলেরা ধুতি পরতে জানে না। বিয়ের দিন কেউ তাদের কোনওমতে ধুতি পরিয়ে দেয়। কোমরে বেল্ট বেঁধে রাখতে হয় যাতে খুলে না যায়।

আমাদের আগের প্রজন্মের বাঙালি ধুতির সঙ্গে পাঞ্জাবি, শার্ট, ফতুয়া, সবেতেই স্বচ্ছন্দ ছিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলতেই ধুতি আর হাতা গুটোনো শার্ট, আর এক নামী গায়ক দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ও তাই। উত্তমকুমার চিত্রনাট্যের প্রয়োজন অনুযায়ী ধুতি পাঞ্জাবি, শার্ট প্যান্ট, স্যুট টাই, যখন যা পড়তেন আমরা মুগ্ধ। পুরোনো বাংলা সিনেমায় বয়স্ক পুরুষদের দেখা যায় ধুতি শার্টের সঙ্গে পাম্প শু, আর শীতকালে ওপরে একটা কোট চাপিয়ে নিতে। অবশ্য সাহেব ঘেঁষা বাঙালি বাড়িতে কমল মিত্র টাইপের ড্রেসিং গাউন পরে দাঁতে পাইপ চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলাটাও একটা স্টাইল ছিল।

আমি স্কুল কলেজের পড়াশোনা রামকৃষ্ণ মিশনে করেছি বলে ধুতি পরার অভ্যাস ছিল। যখন খবরের কাগজে কাজ করি তখনও মাঝে মাঝে ধুতি পাঞ্জাবি পরে অফিসে যেতাম। সহকর্মীদের বেশিরভাগেরই সেটা ভালো লাগত। তবে কিছু প্রগতিশীল চিন্তাধারা সম্পন্ন লোক আবার ব্যঙ্গ করে ‘জামাইবাবু’ বলে মজা পেত।

বাঙালি খাবার দাবারেও স্বাতন্ত্র্য, আমিষ নিরামিষ সবেতেই। কয়েক দশক আগেও বাড়ির বাইরে বাঙালি খাবার জুটত না। রাস্তার পাশে ঝুপড়িতে ভাতের হোটেল ছিল বটে, এমন কোনও রেস্তোরাঁ ছিল না যেখানে সত্যিকারের নেমন্তন্ন বাড়ির মতো খাবার পাওয়া যায়। আর এখন পাড়ায় পাড়ায় বাঙালি খাবারের রেস্তোরাঁ। কয়েকটা এতই উঁচু মানের, যেখানে ভিন রাজ্যের বন্ধুবান্ধব এমনকি বিদেশিদেরও নিয়ে গিয়ে খাওয়ানো যায়। ফুলকো লুচি, মোচার চপ, হেঁচকি, চচ্চড়ি, ডাল, ঝুরি আলুভাজা, বেগুন ভাজার পর ভাত দিয়ে চিংড়ির মালাইকারি, মাছের কালিয়া, পাঁঠার কষা মাংস খেয়ে তাঁদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় বেশ গর্ব অনুভব করি।

ভারতের নানা রাজ্যের খাবার দাবারের পাশে বাঙালি খাবার বেশ ভালোরকম জায়গা করে নিয়েছে। অবাঙালি সেলিব্রেটিরা তো রসগুল্লা আর মিষ্টি দই বলতে অজ্ঞান!

রবিবারের দুপুরে পাঁঠা, আসলে খাসির মাংস ভাত বাঙালির জাতীয় খাবার। আর মাছের সঙ্গে বাঙালির যেন আত্মিক সম্পর্ক। অন্যরা বাঙালিকে ‘মছলিখোর’ বলে ঠাট্টা করে, করুক। মিষ্টি জলের আর সামুদ্রিক মাছ মিলিয়ে এত রকমের রান্না বাঙালি হেঁসেলে হয়, অন্যরা তার থই পায় না। ওই জন্যই আমরা বলি ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। তবে কেন্দ্রীয় একটা সমীক্ষায় দেখা গেছে, মাছ খাওয়ার ব্যাপারে ত্রিপুরা আর কেরালার তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে।

তবু এইসব দোষ গুণ মিলিয়েই আমরা গর্বিত বাঙালি। তবে বাঙালির গর্ব আকাশ ছোঁয়া করে দিয়েছেন যাঁরা, সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কাজি নজরুল ইসলাম… এঁদের কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ। সব বাঙালি মহাপুরুষের নাম দিতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। আর এযুগের সত্যজিৎ রায়, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন আর অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় তো আছেনই। তাই মনে হয়, ভাগ্যিস বাঙালি হয়ে জন্মেছি!