Out of love
Bangla Jago Desk: কৃষ্ণা গুহ রায়: বউদি, আমি যেমন পারব না, খুশিও তো পারবে না।
মেজোবউদি মাথা নাড়লেন, মানে ‘না’ বললেন। ঝুমা খাটের একপাশে শুয়ে কথাগুলো শুনছিল। মেজোবউদি হল ঝুমার মা। যে কথাটা বলল সে হল ঝুমার ছোটপিসি পূর্ণিমা আর খুশি হল ঝুমার জেঠিমার ছোট বোন। ঝুমা বাড়ির সবচেয়ে ছোট মেয়ে। ক্লাস এইটে পড়ে।
ফাল্গুন মাস সবে শেষ হয়েছে। বাতাসে এখনও ঠান্ডা আমেজ।
বৈশাখ মাসে বাড়ির বড় মেয়ে অর্থাৎ ঝুমার জ্যাঠতুতো দিদির বিয়ে। বিয়ের তোড়জোড় চলছে পুরো মাত্রায়। রোজই সকাল সন্ধে চায়ের আসরে বিয়ে বাড়ি নিয়ে আলোচনায় মুখর হয়ে উঠত বাড়ির বৈঠকখানা ঘরটা। ঘটি বাড়ির ছেলের সঙ্গে বাঙাল বাড়ির মেয়ের বিয়ে। বিয়ে বাড়ির তত্ত্ব থেকে স্ত্রী-আচারের খুঁটিনাটি- কোনও কিছুই বাদ নেই। হবু জামাই রেলে চাকরি করে, ভবানীপুরে থাকে। আর মেয়ে চাকরি করে পিডব্লিউডি-তে, রাসবিহারী অঞ্চলে থাকে।
বড় যৌথ পরিবার ঝুমাদের। প্রত্যেকের প্রত্যাশা বিয়েটা যেন সুষ্ঠুভাবে হয়। সেসময় যৌথ পরিবারে রীতি ছিল মেয়ের বিয়েতে যাঁরা খুব নিকট আত্মীয়, তাঁরা বিয়ের উপহার হিসেবে যে জিনিসটি দিতেন, সেটি আর মেয়ের অভিভাবকদের কিনতে হতো না। যেমন কেউ আলমারি, কেউ খাট, কেউ সোনার জিনিস দিত। ঝুমার জ্যাঠতুতো দিদিকেও তেমন দেওয়া হল।
যে দুজন নারী বৈবাহিক কার্যে ব্রাত্য, তাঁদের মধ্যে কনের ছোট মাসি খুশি দিল বিয়ের খাট এবং ছোট পিসি পূর্ণিমা দিল সোনার আংটি। সুষ্ঠুভাবে বিয়ে সম্পন্ন হল। বিয়ের কনেকে সাজিয়ে গুছিয়ে দানসামগ্রী সহকারে শ্বশুরবাড়িতে পাঠানো হল।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঝুমাও বড় হল। ওর প্রিয় বিষয় ইতিহাস। পছন্দের বিষয়ে স্নাতকোত্তর করে সে একটা কলেজে অধ্যাপনা শুরু করল। সেই সঙ্গে ডক্টরেটের জন্য চেষ্টা চালাতে লাগল। ইতিমধ্যে ও জেনে গিয়েছে খুশি মাসি পরিবারের অমতে মুসলিম বিয়ে করেছে আর পূর্ণিমা পিসি নিঃসন্তান। তাই বৈবাহিক কাজে ওরা অদ্ভুত।
ঝুমার সেদিন মাথা ঘুরে গিয়েছিল। ওর এতদিনের পড়াশুনো সব এক মুহূর্তে তছনছ হয়ে গিয়েছিল।
এরই মধ্যে ওর দিদি রুমার বিয়ে ঠিক হল। আবার শুরু হল পুরোনো আলোচনার পুনরাবৃত্তি।
সেদিন রাতের বেলা খাবার আসরে যখন বিয়ের উপহার নিয়ে কথা উঠল, ঝুমা কঠিন স্বরে বলে উঠেছিল এই বিয়েতে খুশি মাসি, আর ছোট পিসি কিছু দিলে নেওয়া হবে না। কথাটা বলা মাত্রই খাবার ঘরের পরিবেশ থমথমে হয়ে গিয়েছিল। বাড়ির সবাই কিছু জিজ্ঞাসা না করলেও সেদিন বুঝেছিল সবার ছোট মেয়েটি এখন বড় হয়ে গিয়েছে।
রাতের বেলা বিছানায় শুয়ে ছোটবেলার ঘটনাগুলো ওর মানসপটে একে একে ভেসে উঠছিল। খুশিমাসি যখন ছেলে মিঠুকে নিয়ে এই বাড়িতে আসত, ওরা কেমন যেন চুপচাপ থাকত। ছোট্ট ঝুমা মিঠুর হাত ধরে টানত খেলা করার জন্য। মিঠু কেমন যেন আড়ষ্টভাবে বসে থাকত। জেঠিমা বলত, “তুই খেল্ গিয়ে, ও যাবে না।”
মা হাঁক পাড়ত, “ঘরে চলে আয়, ঠাকুমা ডাকছে।” সাদা থান পরা ঠাকুমা ঝুমাকে পাশে বসিয়ে ‘তাগো দ্যাশে একখান বাড়ি আছিল’ বলে শতবার বলা সেই গল্প শোনাত। ঝুমা চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞাসা করত, “সেখানে এখন কে থাকে ঠাকুমা?”
সব মুসলমান থাকে।
মুসলমান কারা ঠাকুমা?
বড় হও। সব জানতে পারবা।
সেই ঠাকুমাও একদিন ‘দ্যাশের বাড়ি’র স্মৃতি নিয়ে চোখ বুজলেন। ঝুমাও বড় হল। ইতিহাসের পাতা উলটিয়ে একে একে সবই ওর জানা হয়ে গেল।
নদীর গতি পরিবর্তনের মতন জীবনেরও গতি পালটে যায়।
ঝুমারও একদিন বিয়ে হয়ে গেল। সময়ের চলমানতায় ঝুমাদেরও যৌথ পরিবার একদিন ভেঙে গেল। জেঠু, জেঠিমা, মা, বাবাও গত হলেন।
এখন অধ্যাপনার ফাঁকে সাহিত্যচর্চা করা ওর কাছে একটা নেশার মতো হয়ে গিয়েছে। এই সূত্রে এপার ওপার বাংলার বহু গুণী মানুষের সঙ্গে ওর আত্মিক বাঁধন গড়ে উঠেছে।
একদিন ঝুমার বাড়িতে বাংলাদেশ থেকে দুজন মুসলমান অধ্যাপিকা এসেছিলেন। ওঁরা দিন দুয়েক ছিলেন।
ওঁরা চলে গেলে এক কম বুদ্ধিসম্পন্না প্রতিবেশিনী ঝুমাকে বলেছিল, “আমরা বাঙালি, ওরা তো মুসলমান।”
ঝুমা হেসে বলেছিল, “আমরাও বাঙালি, ওরাও বাঙালি। তুমি কি ওদের অন্য ভাষায় কথা বলতে দেখেছ? আমরাও মাছ-ভাত খেয়েছি, ওরাও তাই খেয়েছে। রবীন্দ্র, নজরুল, জীবনানন্দ, জসীমউদ্দিনের কবিতা তুমিও যেমন পড়েছ, ওরাও পড়েছে।
তুমি মন্দিরে যাও ভগবানকে প্রার্থনা করতে, ওরা মসজিদে যায় আল্লাহর কাছে দোয়া মাগতে।”
একরাশ বিরক্তি নিয়ে প্রতিবেশিনী দরজার দিকে পা বাড়াল। ঝুমা বোঝে, জন্ম থেকেই যে জাতপাতের গোঁড়ামির বিশ্বাস নিয়ে ওই মহিলা আজকে প্রাপ্তবয়স্কা হয়েছে, সেই বিশ্বাসের অচলায়তন ভাঙা ওর কর্ম নয়।
রাতের বেলা বই পড়তে পড়তে দু’ চোখের পাতায় ঘুম জড়িয়ে আসে। মাঝরাতে হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে যায়। চোখ বুজলেও ঘুম আর আসে না। সাম্প্রতিক সময়ে বিভেদের রাজনীতি বড় কষ্ট দেয়। উত্তর কলকাতার দুই বাঙালি বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ যেখানে বিবিধের মাঝে মিলনের স্বপ্ন দেখিয়ে গিয়েছিলেন সেখানে বিবেকানন্দকে নিয়ে যেভাবে বিভেদের চেষ্টা চলছে, তা বড় বেদনাদায়ক। ধর্মপ্রসঙ্গে তিনি স্পষ্ট বলেছেন, “আমরা মানবজাতিকে সেই স্থানে লইয়া যাইতে চাই- যেখানে বেদও নাই, বাইবেলও নাই, কোরানও নাই; অথচ বেদ, বাইবেল ও কোরানের সমন্বয় দ্বারাই ইহা করিতে হইবে। মানবকে শিখাইতে হইবে যে, সকল ধর্ম ‘একত্বরূপ সেই একধর্ম’-এরই বিবিধ প্রকাশ মাত্র…।” সেখানে ধর্মীয় সমন্বয়ের মাধ্যমে দেশগঠনের চেষ্টা না করে চারিদিকে কী নোংরামো চলছে!
বীরভূমের মেয়ে মর্জিনা। খুব সুন্দর বাঁশি বাজায়। রবীন্দ্রভারতী থেকে মিউজিক নিয়ে মাস্টার্স করেছে। কদিন আগে ঝুমার বাড়ি এসেছিল। হঠাৎ করেই ঝুমাকে প্রশ্ন করে বসল, “দিদি পশ্চিমবঙ্গে এন আর সি চালু হলে আমরা কি আর এই দেশে থাকতে পারব না?”
ওর মুখের দিকে কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল ঝুমা। হঠাৎ করেই ওর ঠাকুমার মুখটা মনে পড়ে গেল।
মা, ওঠো ওঠো বেলা হয়ে গেছে। ভোট দিতে যাবে না?
নানারকম চিন্তা করতে করতে কখন যে দু’ চোখের পাতা জড়িয়ে এসেছিল।
মেয়ের ডাকে ঘুম ভাঙল। প্রায় বছর দশেক হল স্বামী গত হয়েছেন। বৃদ্ধা শাশুড়ি, মেয়ে অর্চিতা আর দুইজন মহিলা সারমেয় পুণ্ড, চকোকে নিয়ে ঝুমার দিবারাত্রির কাব্য।
চোখ মেলেই ওর মনে হল, “আত্মসংস্কৃতি বার্ব শিল্পানি”।
ওর চিন্তায়, মননে, বোধে যে বাংলা বর্ণমালা গাঁথা, বিনি সুতোর মালার মত সৃজন শিল্প আত্ম সংস্কৃতিকে ক্রমশ বিকশিত করে চলেছে বলেই তো ও বাঙালি।
অকুণ্ঠ ভালোবাসায় বাংলা শব্দের সহবাস। তাই যখন সুদূর নরওয়ে থেকে প্রবাসী বাঙালি বর্ণালী হালদার প্রস্তাব দিলেন প্রত্যেক মাসে অন্তর্জালে পালন করা হবে বাংলা সংস্কৃতির অনুষ্ঠান, আর ঝুমাকেই এই বিষয়ে দায়িত্ব নিতে হবে, তখন সাগ্রহে রাজি হয়ে গিয়েছিল সে। শুভাকাঙ্ক্ষীরা বলেছিল, ভালোই তো নিজের নামটাও প্রচারিত হবে।
হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন বর্ণালী হালদার, বলেছিলেন, “আত্মপ্রচারের জন্য যে নয়, তা বিলক্ষণ জানি। ঝুমা যে দায়িত্ব নিয়েছে তা বাংলা সংস্কৃতিকে মন থেকে ভালোবেসে।”
হাত মুখ ধুয়ে লিকার চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিল ঝুমা। মনের আনন্দে দু’কলি গেয়েও ফেলল, “পূজাপার্বণ নামাজ রোজা, একইসাথে মরা-বাঁচা…” পরান করিম ভাটিয়ালি গায়। তারপর কুর্তি পরে মাথায় দোপাট্টা জড়িয়ে মেয়েকে নিয়ে ভোটকেন্দ্রর দিকে পা বাড়াল সে।