Bangla Jago Desk,বিকাশ ঘোষ: কয়েক মাস আগে রাজ্য তখন উত্তাল। মধ্যগগনে আরজি কর আন্দোলন। কলকাতা থেকে জেলা সর্বত্রই প্রতিবাদের আগুন। রাত জাগো কর্মসূচিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পথে নেমেছেন মহিলারা। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলগুলি সরকারের পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। তাদের নতুন শ্লোগানও তৈরি হয়ে গিয়েছে। ‘দফা এক দাবি এক, মমতার পদত্যাগ।’ এই নিয়ে সামাজিক মাধ্যম তোলপাড়। এমন ভাবে প্রচার চলছে যেন বাংলায় প্রতি মুহূর্তে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত। বাংলার মেয়েরা পথে বেরোতে পারছেন না। রাস্তায় বেরোলেই তাদের ওপর দুষ্কৃতী হামলা করতে পারে। এমনকি অনেকে এমন ভাবে বাংলার আইন-শৃঙ্খলাকে তুলে ধরতে চেয়েছে যেন জম্মু-কাশ্মীরও হার মানায়। বিরোধী আন্দোলনের চাপে কোণঠাস অবস্থা শাসক দলের নেতা মন্ত্রীদের। রাস্তায় বেরোলেই কুৎসা-বদনামের মুখে পড়তে হচ্ছে।
অথচ উত্তর প্রদেশ, বিহার, মহারাষ্ট্র, দিল্লির মতো রাজ্যে বিভিন্ন সময়ে এমন অনেক অমানবিক ঘটনা ঘটেছে যা গোটা দেশকে নাড়া দিয়ে গিয়েছে। মহিলাদের সুরক্ষার দিক দিয়ে সেই তুলনায় অনেক ভালো জায়গায় পশ্চিমবঙ্গ। কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্ট বলছে নারী সুরক্ষায় এক নম্বরে কলকাতা। এরকম একটি সুরক্ষিত শহরেও আরজি করের মতো ভয়াবহ পাশবিক ঘটনা ঘটে যায়। তিলোত্তমার মৃত্যু কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। একজন মহিলা চিকিৎসক রাত্রে ডিউটিতে ছিলেন। তাঁর সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব সমাজের প্রত্যেকের। প্রশাসন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রত্যেকের। কিন্তু পাশবিক ঘটনার বলি হতে হয় তাঁকে। রাজ্য সরকার এই ঘটনা কোনভাবেই হালকা ভাবে নেয়নি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঘটনার প্রেক্ষিতে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। নিজে ছুটে যান নির্যাতিতার বাড়িতে। ওই পরিবারের পাশে থাকার বার্তা দেন। অপরাধীদের ফাঁসির দাবি করেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। কঠোর আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখেন। রাজ্য বিধানসভায় কঠোর আইন বলবৎ করতে বিল পাস করা হয়।
মুখ্যমন্ত্রীর এত কিছু পদক্ষেপের পরেও নানাভাবে বিরোধী শক্তি অপদস্থ করতে থাকে মুখ্যমন্ত্রীকে। ঘটনার তদন্তে নেমে কলকাতা পুলিশ প্রথমেই মূল অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়কে গ্রেফতার করে। তদন্ত প্রক্রিয়া যখন গুটিয়ে আনছে কলকাতা পুলিশ সেই সময়েও বিরোধীদের দাবি মেনে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন নির্যাতিতার পরিবার যদি সিবিআই তদন্ত চাই তাঁর আপত্তি নেই। অবশ্য বিরোধীদের তর সয় না। তাদের আদালতমুখী প্রবণতা এক্ষেত্রেও বজায় থাকে। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে ঘটনার তদন্ত সিবিআই এর হাতে যায়। কলকাতা পুলিশ সিবিআই এর হাতে তুলে দেয় তদন্ত প্রক্রিয়ার সংগৃহীত তথ্য। আরজি করের ওই পাশবিক ঘটনা নাড়া দিয়ে গিয়েছে বাংলার আপামর জনতাকে। আর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি বাঙালির সেই সেন্টিমেন্টকে সামনে রেখে রাজনীতির ময়দানে ঘুঁটি সাজানোর চেষ্টা করে। সোশ্যাল মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার অপপ্রচার, কুৎসা, বদনাম জারি রাখে। ভুল তথ্য তুলে ধরে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চলে। এমনভাবে প্রচার চালানো হয় যেন সমস্ত অপরাধের মূলে রাজ্যের শাসকদল বা রাজ্যের সরকার।
এই সামাজিক ব্যাধি শুধু পশ্চিমবঙ্গের নয়, গোটা দেশের। এই নিয়ে দেশের শীর্ষ আদালত পর্যালোচনায় স্পষ্ট করেছে। এই নিয়ে টাস্ক ফোর্স গঠন করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। বেশি মহিলাদের নিরাপত্তায় একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের এই পর্যালোচনার পরেও বিরোধীরা রাজ্যে রাজনীতিতে ব্যস্ত ছিল। আর এই রাজনীতির সুফল কুড়োতে ব্যবহার করে জুনিয়র ডাক্তারদের। স্বাস্থ্য ভবনের সামনে টানা ঝরনা অবস্থানে পিছন থেকে মদত চলে। দূর্গা পুজোর সময় টানা আন্দোলন জারি রাখে। ধর্মতলায় মেট্রো চ্যানেলে সামনে অনশন আন্দোলনেও সেই মদত অব্যাহত থাকে। আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া হয় এবার উৎসব নয়। যে উৎসবের সঙ্গে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হয় রাজ্যে, তা পেছন থেকে আঘাত করার চেষ্টা চলে।
আন্দোলনের নাম করে রাজ্যজুড়ে এক ভয়ানক অস্থিরতা তৈরীর চেষ্টা চলে। সেই অস্থিরতা এমনভাবে তৈরি করা হয় যেখানে মানুষের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা হয়, এরাজ্যে সরকার বলে কিছু নেই। প্রথম থেকেই মুখ্যমন্ত্রীর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জুনিয়র ডাক্তারদের পাশে ছিলেন। তাদের প্রতি সহানুমর্মিতা ছিল মুখ্যমন্ত্রীর। বারংবার তাদের পাশে থাকার বার্তা দেন। তবুও বিরোধী আন্দোলনের চাপে অস্থিরতা বজায় রাখার তৎপরতা জারি থাকে। তৃণমূল কংগ্রেস প্রথম থেকে দাবি জানিয়ে আসছিল এর পিছনে রাজনীতির খেলা চলছে। নির্যাতিতার পরিবারের পাশে থাকা নয়, আদতে রাজনৈতিক লাভ খোঁজার চেষ্টা চালাচ্ছে বিরোধীরা। বাংলার জনগণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশেই আছেন।
গায়ের জোরে সরকার বদল নয়, বাংলার জনগণ সিদ্ধান্ত নেবেন কারা সরকারে থাকবে। গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটা সরকার গঠিত হয়েছে। গায়ের জোরে সেই সরকারকে ফেলার ক্ষমতা কারোর নেই। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে রাজ্যে তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসে তৃণমূল কংগ্রেস। আবার ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনেও রাজ্যে নিজেদের শক্তি বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হয় শাসক দল। ২০১৮ সালে বিজেপি ১৮ টি আসন দখল করেছিল পশ্চিমবঙ্গে। ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে সেই আসন কমে দাঁড়ায় ১২। তৃণমূল কংগ্রেস বেশ কয়েকটি আসন বাড়িয়ে নিয়েছে ২৪ এর ভোটে। বর্তমানে তৃণমূলের লোকসভার আসন সংখ্যা ২৯। আর এই লোকসভা ভোটে তৃণমূলের সাফল্যের পর-পরই আরজি করের ঘটনায় উত্তাল হয় রাজ্য। তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্বের দাবি, লোকসভা ভোটে বা তার আগের বিধানসভা ভোটে রাজ্যে কল্কে না পেয়ে পিছনের দরজা দিয়ে রাজ্যে ক্ষমতা দখলের মোহে রয়েছে বিরোধীদের।
রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র করছে বিরোধীরা। যেন তেন প্রকারে রাজ্যে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে। জনগণের সমর্থন না পেলেও কার্যত পরিকল্পিত বিশৃঙ্খল আবহ তৈরি করে নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দেওয়ার রাজনৈতিক চক্রান্ত চালাচ্ছে। তবে জনগণ যে সরকারের পাশে আছে সেই দাবি প্রথম থেকেই করে আসছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ৬ বিধানসভার উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো আরজি কর কান্ডের পর। বিভিন্ন মহলে এই নিয়ে জল্পনা চলছিল, এই ছয় বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে কি আরজি কর ঘটনার কোনো প্রভাব পড়বে? যেভাবে বিরোধীরা আরজি কর ইস্যুতে রাজ্যের শাসককে বেসামাল করে তুলতে সক্ষম হয় তার প্রভাব কি ঘরে তুলতে পারবে বিরোধীরা? নির্বাচনের আগে এই নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানান চর্চা চলে। তবে ভোট ঘোষণার পর থেকেই রাজ্যের শাসক-শিবির ছিল চনমনে। প্রথম দিন থেকেই দাবি করেছিল এই নির্বাচনের ফলাফল হবে ৬-০। কোন কেন্দ্রেই দাঁত ফোটাতে পারবে না বিরোধীরা।
বিজেপির একমাত্র জেতা আসন মাদারী ঘাটেও জোড়া ফুল ফুটবে বলে ঘাসফুল শিবির দাবি জানিয়েছিল। প্রার্থী ঘোষণা থেকে প্রচারে ঝড় সব ক্ষেত্রেই এগিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। শনিবার ছয় বিধানসভা কেন্দ্রের ফলাফল প্রকাশ পেয়েছে। ছয় কেন্দ্রেই সবুজ ঝড়। ঘাসফুলের ঝড়ে মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা পদ্মের। আরজি করকে সামনে রেখে বামেরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও ছয় কেন্দ্রের ভোটের ফলাফল তাদের নিরাশ করেছে। আবারো রাজ্যের মানুষ পছন্দের দল হিসাবে বেছে নিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসকেই। তৃণমূল প্রার্থীদের বিধানসভায় পাঠালেন এই ছয় কেন্দ্রের ভোটাররা। ভোটব্যাঙ্ক অটুট রাখল তৃণমূল কংগ্রেস।
উল্টে বিজেপি দখলে থাকা মাদারিহাট দখল করল তৃণমূল। আর জি করের কোন প্রভাব পড়ল না নির্বাচনে। বিরোধীরা যে ইস্যুকে সামনে রেখে রাজ্যকে বেকায়দায় ফেলার সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল তার সুফল মেলেনি ভোট বাক্সে। আরো বেশি মানুষের সমর্থন নিয়ে এই ছয় কেন্দ্রে ফুটেছে ঘাসফুল। প্রথমবার মাদারিহাটে খাতা খুলেছে তৃণমূল। আরজিকর ইস্যুকে সামনে রেখে বিরোধীদের সমস্ত গেম প্ল্যান ব্যর্থ হয়েছে। এবার কি আবারও বিরোধীরা বলবেন, ‘দফা এক দাবি এক, মমতার পদত্যাগ।’ এই দাবি তোলার মুখ থাকবে বিরোধীদের।