ad
ad

Breaking News

Swami Vivekananda

যুগপুরুষ: স্বামী বিবেকানন্দ

কল্লোলিনী কলকাতার এদিক ওদিক ছড়িয়ে রয়েছে কত না মহাপুরুষের স্মৃতিধন্য বাসগৃহ।

Man of the Era: Swami Vivekananda

চিত্র: সংগৃহীত

Bangla Jago Desk: কল্লোলিনী কলকাতার এদিক ওদিক ছড়িয়ে রয়েছে কত না মহাপুরুষের স্মৃতিধন্য বাসগৃহ। এরকমই একজন মহাপুরুষের প্রাসাদোপম বাসগৃহ চোখে পড়বে উত্তর কলকাতার রাস্তা ধরে হাঁটলে। যে বাসগৃহের ঠিকানা ‘১০৫, বিবেকানন্দ রোড, কলকাতা – ৬। ‘এই বাড়িতেই ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি জন্মেছিলেন যুগ পুরুষ ‘স্বামী বিবেকানন্দ’। স্মৃতিধন্য ঐ বাসগৃহটি বর্তমানে ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ পরিচালিত জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে জনসমক্ষে পরিচিত। স্বামীজির পুরো শৈশব ও প্রথম যৌবন এই বাড়িতেই কাটে। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালাম বাড়ির সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটি উদ্বোধন করেছিলেন। ভারতে স্বামী বিবেকানন্দকে ‘বীর

সন্ন্যাসী’ হিসেবে দেখা হয় এবং তাঁর জন্ম দিনটিকে ‘জাতীয় যুব দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। কে ছিলেন এই স্বামী বিবেকানন্দ? যিনি এখনও সমগ্র বিশ্বে আলোচিত। বরং বলা ভালো কী ছিলেন না তিনি, একাধারে সন্ন্যাসী, দার্শনিক, লেখক, সংগীতজ্ঞ যেমন ছিলেন, অন্যদিকে ছিলেন তেমনি পরমপুরুষ শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রিয় শিষ্য। তিনিই বিশ্বজগতে মানবকল্যাণ ধর্মের অন্যতম প্রবক্তা ও রূপকার।

জগদ্বরেণ্য ধর্মবীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের সন্ন্যাসপূর্ব অর্থাৎ পিতৃদত্ত নাম ছিল ‘নরেন্দ্রনাথ’। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারী উত্তর কলকাতার অন্তর্গত সিমলায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেন নরেন্দ্রনাথ। পিতা বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের খ্যাতনামা অ্যাটর্নি। প্রচুর অর্থ উপার্জন করলেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত দানশীল ও হৃদয়বান ব্যাক্তি। সংগীত চর্চার প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল বিশ্বনাথের এবং নিজেও ছিলেন সুকষ্টের অধিকারী। পরিণত বয়সে নরেন্দ্রনাথ পিতার এই সাংগীতিক সত্তা উত্তরাধিকার সূত্রেই লাভ করেছিলেন। এফএ পড়ার সময়েই নরেন সংগীত বিদ্যায়

যথেষ্ট পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর সুমিষ্ট কন্ঠস্বর পরবর্তীকালে তাঁর সন্যাস-জীবনের ভক্ত ও শিষ্যগণের কাছে অতি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। নরেন্দ্রনাথ কেবলমাত্র কন্ঠ সংগীতেরই চর্চা করেন নি; তবলা, পাখে ায়াজ, এসরাজ, সেতার ইত্যাদি যন্ত্র বিদ্যাও আয়ত্ত করেছিলেন। ধ্রুপদ, খেয়াল, ঠুংরী, টপ্পা, গজল প্রভৃতি গানেও নরেনের সমান পারদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে স্বর্গতরাজনারায়ণ বসুর কন্যার বিবাহোৎসবে নরেন্দ্রনাথ নিমন্ত্রিত হলে সেই বিবাহ বাসরে তিনি রবীন্দ্রনাথ রচিত গান গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন। তবে শিক্ষা ও সংস্কৃতির অঙ্গ হিসাবেই তিনি সংগীতকে তাঁর জীবনে গ্রহণ করেছিলেন।

নরেনের মা ভুবনেশ্বরী দেবী ছিলেন অত্যন্ত শান্ত, সংযত ও ভক্তিপরায়না এক রমণী। বলাবাহুল্য, নরেন্দ্রনাথ বজ্র কঠিন ব্যাক্তিত্ব লাভ করেছিলেন তাঁর মাতার সান্নিধ্যে থেকেই। বাল্যাবস্থায় নরেন্দ্রনাথ দূরন্ত প্রকৃতির থাকলেও পরবর্তীকালে শান্ত, সংযত সন্ন্যাসীর গৈরিকবেশে সমগ্র জগতের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেন।

কলেজে পড়াকালীন নরেন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য দার্শনিকদের বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠ করে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানার বিশেষ কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। এর মধ্যে তাঁর পিতৃ বিয়োগ ঘটে। সংসারিক সংকট দেখা দেয়। শেষে যাবতীয় সমস্যা ও জটিলতার নিরসন হয় দক্ষিনেশ্বরের শ্রীরামকৃষ্ণের পরমহংসদেবের সংস্পর্শে এসে। শ্রীরামকৃষ্ণের সরল মধুর উপদেশ বাণীর অলৌকিক মহিমা নরেন্দ্রনাথ মনে প্রাণে অনুভব করেছিলেন এবং সেই আকর্ষণেই যাতায়াত শুরু করেছিলেন দক্ষিনেশ্বরে। শ্রী রামকৃষ্ণই তাঁকে সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষিত করেন। সেসময়ে তিনি সংসারের সর্বপ্রকার সংস্কার, নাম ও উপাধি ত্যাগ করে ‘বিবিদিষানন্দ’, ‘সচ্চিদানন্দ’ ইত্যাদি নামে পরিচিত হন সকলের কাছে। তবে আমেরিকা যাত্রার প্রাক্কালে তিনি ‘বিবেকানন্দ’ নাম গ্রহণ করেন এবং সেই বিশিষ্ট নামেই পরবর্তীকালে

জগৎব্যাপী খ্যাতি লাভ করেন। শ্রীরামকৃষ্ণের চোখে নরেন্দ্রনাথ ছিলেন শিষ্যদের মধ্যে সব থেকে আদর্শবান। কাশী পুরে শ্রীরামকৃষ্ণদেব একদিন একটি কাগজে লিখে দিয়েছিলেন, ‘নরেন শিক্ষা দেবে’। অর্থাৎ আধ্যাত্মিক জগতের যে মহান সত্যগুলি তিনি উপলব্ধি করেছেন, নরেন সেগুলি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেবে। নরেন্দ্রনাথ তখন প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘আমি ওসব পারব না।’ ঠাকুর হেসে বলেছিলেন, ক্ষ্ম তোর ঘাড় পারবে। মা ঘাড় ধরে তোকে দিয়ে করিয়ে নেবেন।ক্ষ্ম পরবর্তী সময়ে শ্রীরামকৃষ্ণের সে ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছিল। পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের উদার সান্নিধ্যে এসেছিলেন বলেই নরেন্দ্রনাথ মানুষের প্রতি এত তীব্র ভালোবাসা হৃদয়ে অনুভব করেছিলেন।

তাঁর বাণী হয়ে উঠেছিল এত তেজোদৃপ্ত ও মর্মস্পর্শী। শ্রীরামকৃষ্ণ সর্বজীবে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করে বলেছিলেন, মাটির প্রতিমায় ঈশ্বরের পুজো হয়, আর জ্যান্ত মানুষে তাঁর পূজা হয় না? ক্ষ্ম মানুষের সেবাই যে প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের সেবা—এই সত্য নরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী থেকেই নরেন্দ্রনাথ জগতের বহু সমস্যা দূর করার উপায় খুঁজে পেয়েছিলেন।’…. জীবে দয়া নয়- শিব জ্ঞানে জীবের সেবা’-এই মহৎ আদর্শ- ই পরবর্তীকালে সারা বিশ্বে প্রচার করেছিলেন নরেন্দ্রনাথ। ভারতবর্ষের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত পরিভ্রমণ করে স্বামীজি বহিরঙ্গ রূপই কেবল দর্শন করেন নি, অন্তরাত্মার সঙ্গেও পরিচিত হয়েছিলেন। সেজন্য ভারতবর্ষের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁর চিন্তা বা পরিকল্পনা নির্ভুল ও নিখুঁত হয়েছিল। ভারতবর্ষ সম্পর্কে এরূপ গভীর উপলব্ধি পূর্ববর্তী বা পরবর্তী ভারতের অপর কোন সন্ন্যাসী তো দূরের কথা, কোন গৃহী দেশপ্রেমিকের পক্ষেও সম্ভবপর হয় নি।

স্বামীজির জীবনে শিকাগো ধর্মমহা সভা ইতিহাসে একটি স্মরনীয় ঘটনা। ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিকতা আর ভারতবাসীর গৌরবময় ঐতিহ্যের কথা বহিজগতে সেই প্রথম শুনিয়েছিলেন এক ভারতবাসী। নিবেদিতা বলেছিলেন, গুরু, শাস্ত্র ও মাতৃভূমি এই তিনটি সুর মিলিয়ে স্বামীজি এক মহাসঙ্গীত রচনা করেছিলেন।

শিকাগো ধর্মমহাসভায় সেই সঙ্গীত সহস্র সহস্র নরনারী শুনেছিলেন। শিকাগো ধর্মমহাসভায় স্বামীজির আবির্ভাবের পিছনে ছিল শ্রীরামকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক শক্তি এবং তাঁর নিজস্ব আধ্যাত্মিক সাধনা, অভিজ্ঞতা, অনুভূতি এবং উপলব্ধির ঐশ্বর্য।

শিল্পী যেমন পরম নিষ্ঠা সহকারে তার শিল্পকর্ম রচনা করেন, তেমনি শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর অন্তরের সকল ঐশ্বর্য দিয়ে নরেন্দ্রনাথকে গড়ে তুলেছিলেন। এর ফলেই আমরা পেয়েছি বিশ্বপথপ্রদর্শক বিবেকানন্দকে।

স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন যুব সমাজের এক আদর্শ প্রতিনিধিস্বরূপ। তাঁর অনন্ত জ্যোতি, অপরিমেয় মেধা, ধীশক্তি এবং প্রেমময়তা যুগে যুগে সমগ্র জাতিকে অফুরন্ত অনুপ্রেরণা জুগিয়ে গিয়েছে। প্রতি বছর ১২ জানুয়ারী দিনটি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে সারা দেশ জুড়ে উদযাপিত হয় ‘জাতীয় যুব দিবস’। তবুও আধুনিক প্রজন্মের যুব সমাজে বিবেকানন্দের প্রভাব সত্যিই ঠিক কতটা তা সংশয় জাগে।