চিত্র: সংগৃহীত
Bangla Jago Desk: অনন্যা ভট্টাচার্য: বর্তমান সময়ে নিরাপত্তাহীনতা একটি সাধারণ এবং গভীর সামাজিক সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। যা আজকের যুব সমাজের মানসিক এবং সামাজিক অবস্থার ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি, সামাজিক প্রত্যাশার চাপ, ব্যক্তিগত জীবন ও পেশাগত জীবনে প্রতিযোগিতার বাড়বাড়ন্ত এবং বিশ্বায়নের প্রভাবে যুব সমাজ ক্রমশ একধরনের মানসিক টানাপড়েন এবং নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।
নিরাপত্তাহীনতার কারণসমূহ–
১. সামাজিক প্রত্যাশা ও প্রতিযোগিতা
আজকের সমাজে যুবকদের ওপর চরম প্রত্যাশার চাপ রয়েছে। পরিবার, সমাজ এবং প্রতিষ্ঠান থেকে তারা একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ড পূরণের জন্য চাপ অনুভব করে। শিক্ষাগত সাফল্য, চাকরি, আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং ব্যক্তিগত জীবনে সাফল্য অর্জন করতে না পারলে তাদের অনেকেই নিজেদের ব্যর্থ মনে করে। এই চাপ তাদের আত্মবিশ্বাসকে দুর্বল করে তোলে এবং নিরাপত্তাহীনতার বীজ বপন করে।
২. প্রযুক্তির প্রভাব ও সামাজিক মাধ্যম
সামাজিক মাধ্যমের বিস্তার যুব সমাজের জীবনে একটি বড় প্রভাব ফেলেছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলিতে নিজের জীবনের কৃত্রিম এবং সাজানো দিক তুলে ধরে অন্যদের সামনে সেরা চেহারা দেখানোর প্রবণতা তৈরি হয়েছে। অন্যের জীবনের সঙ্গে নিজের তুলনা করতে গিয়ে অনেক যুবক-যুবতী নিজেদের অপ্রতুল মনে করে। এর ফলে মানসিক চাপে ভোগা এবং নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি বেড়ে যায়।
৩. পরিবার ও সম্পর্কের টানাপড়েন
পরিবারের মধ্যে দূরত্ব এবং সম্পর্কের জটিলতা অনেক সময় যুবকদের নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দেয়। বর্তমান পারিবারিক কাঠামোর ভাঙন এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব তাদের মানসিক স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলছে। একই সঙ্গে রোমান্টিক সম্পর্কের ব্যর্থতা এবং বন্ধুত্বের ভাঙনও তাদের নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়ে তোলে।
৪. অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা
বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অবস্থা, বেকারত্বের হার বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা যুবসমাজে নিরাপত্তাহীনতার অন্যতম কারণ। উচ্চশিক্ষিত হয়েও অনেক যুবক তাদের উপযুক্ত চাকরি পাচ্ছে না, যা তাদের আত্মবিশ্বাসে চরম আঘাত হানে।
৫. মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা
মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যা যেমন উদ্বেগ, হতাশা, প্যানিক অ্যাটাক ইত্যাদি যুব সমাজের মধ্যে দিন দিন বাড়ছে। এই সমস্যা একদিকে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করছে এবং অন্যদিকে তাদের নিরাপত্তাহীনতার মাত্রা আরও গভীর করছে।
নিরাপত্তাহীনতার প্রভাব—
১. আত্মবিশ্বাস হ্রাস
নিরাপত্তাহীনতা যুব সমাজের আত্মবিশ্বাসকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তারা নিজেদের ছোট এবং অসফল মনে করে, যা তাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
২. সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি
নিরাপত্তাহীনতা যুব সমাজের পারস্পরিক সম্পর্কগুলির মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে। বন্ধুত্ব, প্রেম কিংবা পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তারা সবসময় একটি ভয় এবং অনাস্থার মধ্যে থাকে।
৩. অপরাধমূলক কার্যকলাপে জড়ানো
নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেকে দ্রুত সফল হওয়ার জন্য অপরাধমূলক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে। মাদকাসক্তি, প্রতারণা, এবং চুরি-ডাকাতির মতো কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়া এরই উদাহরণ।
৪. শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি
নিরাপত্তাহীনতা শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। মানসিক চাপের কারণে শারীরিক অসুস্থতা যেমন উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, এবং ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়।
৫. সমাজের অগ্রগতিতে বাধা
যুব সমাজের নিরাপত্তাহীনতা একটি জাতির ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক সমস্যা। তরুণ প্রজন্ম যদি মানসিক এবং শারীরিকভাবে স্থিতিশীল না হয়, তাহলে তারা সমাজের অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করবে।
নিরাপত্তাহীনতা মানসিক স্বাস্থ্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে এবং এটি বিভিন্ন মানসিক রোগের কারণ হতে পারে। নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি দীর্ঘস্থায়ী হলে এটি যুবসমাজসহ যে কোনও ব্যক্তির মানসিক সুস্থতার জন্য মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। এখানেউল্লেখ করা হল, কী কী মানসিক রোগ নিরাপত্তাহীনতার কারণে হতে পারে:
১. উদ্বেগজনিত রোগ (Anxiety Disorders)
নিরাপত্তাহীনতা দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগের জন্ম দিতে পারে। এটি সাধারণত বিভিন্ন রকম উদ্বেগজনিত সমস্যায় রূপান্তরিত হয়, যেমন- সামাজিক উদ্বেগ (Social Anxiety) অন্যদের সামনে নিজের আচরণ বা উপস্থিতি নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তিত হওয়া। জেনারালাইজড অ্যানজাইটি ডিসঅর্ডার (GAD) জীবন এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে একটানা অযৌক্তিক দুশ্চিন্তা করা। প্যানিক ডিসঅর্ডার হঠাৎ করে ভয় এবং আতঙ্কের আক্রমণ হওয়া।
২. ডিপ্রেশন (Depression)
নিরাপত্তাহীনতার ফলে নিজের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলা এবং ব্যর্থতার অনুভূতি থেকে হতাশা সৃষ্টি হতে পারে। ডিপ্রেশন হলে ব্যক্তি দীর্ঘ সময় ধরেকোনও কিছুতে আগ্রহ হারায়।নিজের অক্ষমতা এবং দুঃখবোধ নিয়ে চিন্তিত থাকে।আত্মহত্যার চিন্তা পর্যন্ত করতে পারে।
৩. পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD)
যদি নিরাপত্তাহীনতার কারণ কোনও ট্রমাটিক ঘটনা হয় (যেমন, সম্পর্কের ভাঙন, চাকরি হারানো, বা শারীরিক নির্যাতন), তা ব্যক্তির মধ্যে PTSD সৃষ্টি করতে পারে। এর ফলেঅতীতের ঘটনার স্মৃতি বারবার ফিরে আসে।ভয় এবং আতঙ্কজনিত সমস্যা দেখা দেয়।
৪. অবসেসিভ-কমপালসিভ ডিসঅর্ডার (OCD)
নিরাপত্তাহীনতা থেকে কিছু মানুষ অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণে লিপ্ত হয়। এটি OCD-তে রূপান্তরিত হতে পারে। যেমন, অতিরিক্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা।প্রতিনিয়ত নিজের কাজের বিষয়ে সন্দেহ করা।
৫. আত্মসম্মানহীনতা এবং আত্ম-পরিচয় সংকট (Low Self-esteem and Identity Crisis)
যেসব মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, তাদের আত্মবিশ্বাস এবং আত্মসম্মান হ্রাস পায়। এটি দীর্ঘমেয়াদেআত্ম-পরিচয়ের সংকটে ফেলে। তারা নিজেদের মূল্যহীন মনে করতে শুরু করে।
৬. অ্যাডিকশন বা আসক্তি (Addiction)
নিরাপত্তাহীনতার মোকাবিলা করতে অনেক মানুষ মাদক, অ্যালকোহল, বা ধূমপানের মতো আসক্তির আশ্রয় নেয়। তবে এই অভ্যাস মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের আরও অবনতি ঘটায়।
৭. বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার (BPD)
নিরাপত্তাহীনতা যদি সম্পর্কের ক্ষেত্রে হয়, তা BPD-এর জন্ম দিতে পারে। এটি সাধারণতসম্পর্কের মধ্যে অতিরিক্ত সন্দেহ।দ্রুত মেজাজের পরিবর্তন।একাকিত্ব এবং পরিত্যক্ত হওয়ার ভয় সৃষ্টি করে।
৮. হতাশাজনিত খাওয়ার রোগ (Eating Disorders)
নিজের শরীর এবং চেহারা নিয়ে নিরাপত্তাহীনতা অনেক ক্ষেত্রে বুলিমিয়া বা অ্যানোরেক্সিয়া-এর মতো খাওয়ার অভ্যাসজনিত মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করে।অতিরিক্ত ওজন কমানোর চেষ্টা।অস্বাভাবিক ডায়েট এবং শরীরের প্রতি অবজ্ঞা।
৯. সাইকোসোমাটিক ডিজঅর্ডার (Psychosomatic Disorders)
নিরাপত্তাহীনতা কখনও শারীরিক অসুস্থতার মতো অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে, যা আসলে মানসিক রোগের অংশ। যেমন, মাথাব্যথা। হজমের সমস্যা। বুকে ব্যথা।
১০. ফোবিয়া (Phobias)
নিরাপত্তাহীনতা থেকে বিভিন্ন ধরনের ভয় (ফোবিয়া) জন্ম নিতে পারে। যেমন, একাকিত্বের ভয় (Monophobia)।জনসম্মুখে থাকার ভয় (Agoraphobia)।
সমাধান এবং উত্তরণের উপায়
১. সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান
যুব সমাজকে সঠিক দিকনির্দেশনা এবং মানসিক সমর্থন প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি। পরিবার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে যুবকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে এবং তাদের উদ্বেগ ও সমস্যাগুলি শুনতে হবে।
২. সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি
নিরাপত্তাহীনতা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য সমাজে প্রচারণা চালানো দরকার। মিডিয়া এবং প্রতিষ্ঠানগুলিকে এই বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
৩. মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা
মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা যুব সমাজের জন্য সহজলভ্য এবং গ্রহণযোগ্য করতে হবে। পরামর্শদাতা, মনোবিজ্ঞানী, এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলার জন্য উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে।
৪. সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ
যুবসমাজকে সামাজিক মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহারের নেতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন করতে হবে এবং এটি সঠিকভাবে ব্যবহারের দিকনির্দেশনা দিতে হবে।
৫. উদ্যোগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি
বেকারত্বের হার কমাতে এবং যুবকদের আর্থিক নিরাপত্তা দিতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা দরকার। এ ক্ষেত্রে সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলির সম্মিলিত প্রচেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ।
৬. সৃজনশীল কাজে অংশগ্রহণ
যুবকদের সৃজনশীল কাজে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করতে হবে। খেলাধুলো, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ ইত্যাদির মাধ্যমে তারা নিজেদের আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধার করতে পারে।
নিরাপত্তাহীনতা আজকের যুব সমাজের জন্য একটি জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। এটি কেবল তাদের ব্যক্তিগত জীবনকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং সমগ্র সমাজের উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। নিরাপত্তাহীনতা থেকে মুক্তি পেতে হলে পরিবার, সমাজ, এবং সরকারের একসঙ্গে কাজ করা দরকার। সঠিক দিকনির্দেশনা, মানসিক সমর্থন, এবং বাস্তবসম্মত লক্ষ্য স্থাপনই পারে এই সমস্যার সমাধান করতে। তরুণ প্রজন্মই জাতির ভবিষ্যৎ, এবং তাদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব।