Bangla Jago Desk,বিপ্লব চৌধুরী: ব্যক্তির নাম প্রদোষ চন্দ্র মিত্র, ঠিকনা-২১, রজনী সেন রোড, কলকাতা -৭০০০২৯। ব্যস এটুকু বললেই কারও বুঝতে অসুবিধে হবে না, আমি ঠিক কার কথা বলছি। আমি বলছি কিশোর থেকে বয়স্কদের কাছের মানুষসত্যজিৎ রায় সৃষ্ট আমাদের সবার প্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র ফেলুদার কথা। ৬ফুট’ ২ইঞ্চি উচ্চতা বিশিষ্ট, মার্শাল আর্টে দক্ষ, মেদবিহীন, সুঠাম শরীরের ২৭ বছর বয়সী ফেলুদা, যে অসম্ভব ভাল বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণের ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে যেকোনও অপরাধমূলক ঘটনার সমাধান করতে ছিল সিদ্ধহস্ত। তাঁর এই বিশেষ ক্ষমতাকে সে মজা করে বলত মগজাস্ত্র।
আর সঙ্গে ছিল তাঁর সহকারীনিজের খুড়তুতো ভাই তপেশরঞ্জন মিত্র ওরফে তোপসে। আজ প্রবেশ করতে চাই ফেলুদার মগজাস্ত্রের অন্তঃপুরে। ফেলুদার মগজাস্ত্রের মধ্যে আসলে অনেকগুলি অস্ত্রের সমন্বয় ছিল। ওই অস্ত্রগুলির নামকরণ এরকম করলে মন্দ হয় না, যেমন- অবিশ্বাস অস্ত্র, যাচাই অস্ত্র, অগাধ অধ্যয়ন অস্ত্র, পর্যবেক্ষণ অস্ত্র, ঘটনাক্রম অনুধাবন অস্ত্র, ধাঁধার অর্থ উন্মোচন অস্ত্র, যুক্তিবাদী মনন অস্ত্র, পরামর্শ অস্ত্র।ফেলুদার কাছে অবিশ্বাস ও যাচাইয়ের গুরুত্ব ভীষণ। সে বলে অবিশ্বাস না করলে নাকি গোয়েন্দা হওয়াই যায় না। হত্যাপুরী গল্পে ফেলুদা লালমোহন গাঙ্গুলি (ছদ্মনাম জটায়ু)-কে বলে ‘সন্দেহ জিনিসটা গোয়ান্দাগিরির একটা অপরিহার্য অঙ্গ লালমোহন বাবু।
কেন, আপনার গোয়েন্দা প্রখর রুদ্র কি ওই বাতিক থেকে মুক্ত?’ ফেলুদা যেমন অন্যের কথা যাচাইকরে নেয়, তেমন নিজের প্রতিটি সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপকেও যাচাই করতে ভলে না কখনও। তাই যখন ফেলুদা তোপসেকে বলে ‘তুই যা ভাবছিস তা নয়, তোপসে’- তার মানে ফেলুদা যেন সেইসঙ্গে নিজেকেও যাচাই করে নেয়। ফেলুদার অধ্যয়ন সবার জানা। প্রচুর বই পড়া, সাম্প্রতিক ঘটনা সম্পর্কে সজাগ একজন মানুষ। নিজের দেশের শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে শুধু নয়, বিদেশের নানা প্রবন্ধ, পৌরাণিক কাহিনি বিষয়ে ছিল সম্যক জ্ঞান। প্রতিটি কেস সমাধান করতে যাওয়ার দৃশ্যে ফেলুদাকে পাই বই পাঠরত অবস্থায়। ঘটনাক্রম অনুধাবন করে ও পর্যবেক্ষণের দ্বারা অপরাধের প্রধান দোষী পর্যন্ত পৌঁছনোয় তাঁর বিশেষ দক্ষতা ছিল।
বুদ্ধিমান গোয়েন্দা ফেলুদা অনেক অপরাধ রহস্যের সমাধান করে তাঁর অসামান্য ধাঁধা ও সংকেতের অর্থ উন্মোচন ক্ষমতার মধ্য দিয়ে। ‘সোনার কেল্লা’ গল্পে ফেলুদার হাতে আসা একটি চিরকুটে লেখা ছিল ‘IP- 16.25 U-M’ -এর অর্থ ‘আমি পোখরান পৌঁছচ্ছি, তুমি মিত্তিরকে আটকাও’। ফলে ফেলুদা সম্ভাব্য হামলা সম্পর্কে আগে থেকেই সচেতন হয়ে যায়। ‘ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা’তেও আছে ধাঁধা। টিয়াপাখির বলা কথা- ‘ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন একটু জিরো’- এটা আসলে সিন্দুকের তালা খোলার কম্বিনেশন, যা সহজেই ফেলুদা বুঝে উঠতে পেরেছিল। এরকম ‘সমাদ্দারের চাবি’, ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’, ‘বাদশাহি আংটি’ প্রভৃতি উপন্যাসে ফেলুদার নানা ধাঁধার অর্থ উন্মোচনের দ্বারা অপরাধ রহস্যের সমাধান ক্ষমতার পরিচয় মেলে। ফেলুদা ছিল যুক্তিবাদী মানুষ তাই খুব সহজেই ভণ্ড সাধু ও জ্যোতিষীদের যেমন- ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ গল্পে মছলিবাবা, ‘হত্যাপুরী’তে লক্ষণবাবু , ‘গোঁসাইপুর সরগরম’-এ প্ল্যানচেট করা ভদ্রলোক- এদের সবার ভণ্ডামি ধরে ফেলে।
ফেলুদা তাঁর কেস সংক্রান্ত কোনও বিষয়ে একটু বাধাপ্রাপ্ত হলে বা খটকা লাগলে সবজান্তা সিধু জ্যাঠার পরামর্শ নিতে দেরি করেনি। আর সিধু জ্যাঠাও চিরাচরিত ব্যাঙ্গাত্মক ঢংয়ে সব জিজ্ঞাসা, অজানা তথ্যের উত্তর দিয়ে সাহায্য করেছেন ফেলুদাকে। সিধু জ্যাঠা কিছু ইংরেজে শব্দের হাস্যকর বাংলা করেন এইভাবে- Para Psychology- ‘পাড়া ছাই চলো যাই’, Exhibition- ‘ইস্ কী ভীষণ’, Impossible – ‘আম পচে বেল’, Governor- ‘গোবরনাড়ু’ ইত্যাদি। আজকের দিনে ফেক নিউজ ও ফেক ভিডিয়ো-র যুগে দাঁড়িয়ে আমাদের সবার ফেলুদার মতো মগজাস্ত্রের অন্তর্গত যাচাই ও যুক্তির ব্যবহার করা অত্যন্ত আবশ্যিক।