ad
ad

Breaking News

Chittaranjan Das

স্মরণে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ

১৯২৫ সালের ১৬ জুন দার্জিলিংয়ে দিন কয়েক জ্বর ভোগের পরই হঠাৎ প্রয়াত হলেন দেশবন্ধু।

In memory of our comrade Chittaranjan Das

চিত্র: সংগৃহীত

Bangla Jago Desk: রাজু পারাল: ১৯২৫ সালের ১৬ জুন দার্জিলিংয়ে দিন কয়েক জ্বর ভোগের পরই হঠাৎ প্রয়াত হলেন দেশবন্ধু। সংবাদটি দেশ-বিদেশের সঙ্গে মান্দালয় জেলে পৌঁছলে শোকে স্তব্ধ হয়ে যান সুভাষচন্দ্র। সে সময়ে পূর্ববঙ্গ সফরে ছিলেন মহাত্মা গান্ধি। তিনি সব কাজ বাতিল করে ফিরে এলেন কলকাতায়।

দার্জিলিং মেলে দেশবন্ধুর দেহ আসছে কলকাতায়। খবরটা পাওয়া মাত্রই অগণিত জনতা সেদিন বেরিয়ে পড়েছিল রাস্তায়। দেশের সর্বত্র শোকের বন্যা। শিয়ালদা স্টেশনে জনসমুদ্র, দুই লক্ষ লোকের শবানুগমন। ধনী, দরিদ্র, উচ্চ নীচের সমস্বরে আর্তনাদ। কেওড়াতলা শ্মশান ঘাটে সব শেষ। দেশ স্তব্ধই হয়ে গেল ওই সময়ে। প্রিয় নেতাকে অভিবাদন জানাতে ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি চতুর্দিকে।’ তাঁর প্রয়াণের খবরে শোকার্ত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ লিখলেন;

“এনেছিলেন সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ।

মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।”

দেশ ও দশের মঙ্গল কামনায় সব সময়ই নিজেকে যুক্ত রেখে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছিলেন বাংলা ও বাঙালির আপনজন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর একটি ঘোষণা থেকেই বোঝা যায় তাঁর দেশ ভক্তি কতটা গভীর ছিল ‘স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে গিয়ে যদি আমার মৃত্যু হয়, তা হলে আমার বিশ্বাস আমি বারে বারে এই দেশেই জন্মগ্রহণ করবো। এ দেশের জন্যই বাঁচবো। এ দেশের জন্যই ভাববো। এ দেশের জন্যই সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করবো। যতদিন না আমার ইপ্সিত লক্ষ্য পূরণ হয়।’

দেশবাসীর কল্যাণের জন্য নিজের ব্যক্তিগত সুখ-স্বাছন্দ্য, আহার-নিদ্রা, ধন-দৌলত সর্বস্ব ত্যাগ করেছিলেন বলেই জনগণ তাঁকে ‘দেশবন্ধু’ আখ্যায় ভূষিত করেন। ১৯২১ সালের জানুয়ারি মাসে বিপিন বিহারী দাসগুপ্ত তাঁকে ‘দেশবন্ধু’ আখ্যা দেন। তবে বাংলার এই বীর সন্তান ‘সিআর দাশ’ নামেও বেশি পরিচিত ছিলেন।

স্বদেশ প্রেমিক, মানব দরদি ও বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের পৈত্রিক নিবাস ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের অন্তর্গত তেলিরবাগ গ্রামে। একসময় এই বিক্রমপুর বাংলার অতীত গৌরব ছিল। এখান থেকেই বাংলা একদিন শিল্পে, বাণিজ্যে, সাহিত্যে ও ধর্মে শুধু ভারতেই নয়, ভারতের বাইরেও উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাই পিতৃভূমি বিক্রমপুরকে মনপ্রাণ দিয়ে গভীর শ্রদ্ধা করতেন চিত্তরঞ্জন।

১৮৭০ সালের ৫ নভেম্বর কলকাতার পটলডাঙা স্ট্রিটের বাসভবনে মাতা নিস্তারিণী দেবীর কোল আলো করে জন্ম নেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন। পরে অবশ্য তাঁদের পরিবার ভবানীপুরের রসা রোডের বাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। আট ভাই-বোনের মধ্যে চিত্তরঞ্জন ছিলেন দ্বিতীয়। পিতা ভুবনমোহন দাশ ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের একজন বিশিষ্ট আইনজীবী। মার্জিত রুচি, উদার হৃদয় আর মহানুভবতা ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। অপরের দুঃখে সশামিল হয়ে সর্বদাই তিনি চেষ্টা করতেন তাঁদের কিছু আর্থিক সাহায্য করতে। এই সহৃদয়তা ও মহানুভবতার জন্য তাঁর পরিবার একসময় ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে চিত্তরঞ্জন পিতার সেই বিপুল ঋণ পরিশোধ করেন একজন প্রখ্যাত আইনবিদ হয়ে।

চিত্তরঞ্জনের পিতা ভুবনমোহন ছিলেন একজন সুলেখক। তাঁর স্বরচিত কবিতা ও সঙ্গীতগুলির ভাষা ছিল সরল ও সাবলীল। আন্তরিক ও সতেজ লেখনীর জন্য তিনি সেকালের ‘ব্রাহ্মজনমত’ পত্রিকার সম্পাদনার পদ অলংকৃত করে বাংলার সাংবাদিক জীবনে একটি বিশিষ্ট স্থান লাভ করেছিলেন। পিতার বিভিন্ন কার্যকলাপ বাল্যকাল থেকেই চিত্তরঞ্জনের মনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। তবে চিত্তরঞ্জনের জীবনে মা নিস্তারিণী দেবীর প্রভাব ছিল খুব বেশি।

তাঁর মাতৃভক্তি ছিল অতুলনীয়। তাঁর মাতৃভক্তির কথা উল্লেখ করে দেশনায়ক সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন, ‘পারিবারিক জীবনে তাঁহার মাতৃভক্তির কথা অনেকেই জানেন। আলিপুর জেলে বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা মায়ের তিনটি রূপের বর্ণনা পড়িতে পড়িতে তিনি বিভোর হইয়া যাইতেন। তখন তাঁহাকে দেখিলে বোঝা যাইত তাঁহার অন্তরের অন্তঃস্থলে মাতৃভক্তি কত গভীর।’

 মা নিস্তারিণী দেবীর আশীর্বাদ ছিল তাঁর সকল প্রেরণার উৎস। ঐতিহাসিক বোমা মামলায় শ্রী অরবিন্দের পক্ষে দাঁড়াবার জন্য সকলে তাঁকে অনুরোধ করলেও, মায়ের ঐকান্তিক আগ্রহই তাঁকে সবথেকে বেশি উৎসাহিত করে। নিস্তারিণী দেবী ছিলেন উদার হৃদয়, অতিথি পরায়ণ ও ন্যায়নিষ্ঠ।

জীবনে উচ্চশিক্ষা না পেলেও সহজাত ধীশক্তি ও প্রতিভার অধিকারিণী ছিলেন তিনি। বলাবাহুল্য, বাবা-মায়ের চরিত্রের অনেক গুণ চিত্তরঞ্জনের ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে অল্প বয়েসেই। পারিবারিক শিক্ষা ও অনুশাসনই বালক চিত্তরঞ্জনকে পরবর্তীকালে মানুষ চিত্তরঞ্জন গড়ে তোলে।

‘উদারতা’ ও ‘ত্যাগ’ চিত্তরঞ্জনের অন্তরে বাল্যাবস্থায় অধিকার করে বসলেও দেশভক্তির গুণও তাঁর মধ্যে অতিমাত্রায় দেখা যেত। বাল্যকালেই কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়’ এবং কবি হেমচন্দ্রের ‘ভারত সঙ্গীত’ কবিতা দুটি ছিল তাঁর অতি প্রিয়। প্রায়ই কবিতা দুটি আবৃত্তি করে মনের মধ্যে জাগিয়ে তুলতেন স্বাধীনতার স্পৃহা।

চিত্তরঞ্জনের শিক্ষাজীবন শুরু হয় ভবানীপুরের লন্ডন মিশনারি সোসাইটির স্কুলে। ১৮৮৬ সালে এখান থেকেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ ভর্তি হন। ১৮৯০ সালে এখান থেকে বিএ পাস করে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি দেন লন্ডনে। লক্ষ্য আইসিএস হওয়া। কিন্তু সেখানে ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় সেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি। শেষমেশ তিনি লন্ডনের ‘মিডল টেম্পল’ থেকে ব্যারিস্টার পাস করে দেশে ফেরেন।

কঠোর পরিশ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে আইন ব্যবসায় লড়াই চালিয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি সফল ব্যারিস্টার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তবে অর্থ উপার্জন তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য ছিল না। তাই আইনজীবী রূপে দেশের মানুষের সেবায় ব্রতী হন তিনি। আইনে তাঁর অসামান্য পাণ্ডিত্য ও বিশ্লেষণী শক্তি বিচারপতিদের মুগ্ধ করে সমসাময়িক সময়ে। সাক্ষীকে জেরা করে নাজেহাল করা এবং প্রদত্ত সাক্ষ্য ও প্রমাণ নিজের মক্কেলের অনুকূলে কাজে লাগানো ছিল চিত্তরঞ্জনের বৈশিষ্ট্য।

১৯০৭ সালে একজন সফল আইনজীবী রূপে সকলের কাছে পরিচিত হন তিনি। প্রায় সেই সময় থেকেই তাঁকে দেশপ্রেমিক ও দেশকর্মীদের রক্ষক রূপে দেখা যায়। ১৯০৮ সালে আলিপুর বোমা ষড়যন্ত্র মামলায় বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষকে গ্রেফতার করা হলে তিনি অরবিন্দের পক্ষ সমর্থন করেন। কঠোর পরিশ্রম করে ও আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করে শেষ পর্যন্ত তিনি বিপ্লবী অরবিন্দকে বাঁচান। তাঁর প্রখর আইনজ্ঞান ও বাকশক্তির বলে অরবিন্দ সমস্ত অভিযোগ থেকে শেষপর্যন্ত মুক্তি লাভ করেন। দেশপ্রেমিক ও বিশিষ্ট আইনজীবী হিসেবে এই সময় থেকেই চিত্তরঞ্জনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।

বাল্যকালেই চিত্তরঞ্জন ভারতের অন্যতম সুপরিচিত নেতা বিপিনচন্দ্র পালের সংস্পর্শে আসেন। ১৯০৬ সাল চিত্তরঞ্জনের রাজনৈতিক জীবনের একটি স্মরণীয় বছর। কারণ ওই বছরেই তিনি কলকাতা কংগ্রেসের বিশেষ অতিথি হয়ে কংগ্রেস দলের কাজকর্মে সঙ্গী হন। তবে তাঁর প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে প্রবেশ ঘটে ১৯১৭ সালের জাতীয় কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক জাতীয় সমিতির সভাপতি হয়ে। ১৯২০ সালে মহাত্মা গান্ধির ডাকা অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করে তীব্র রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন চিত্তরঞ্জন। ১৯২১ সালে আইন অমান্য করে কারাবরণও করেন শেষপর্যন্ত।

তবে রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার আগে ও পরে চিত্তরঞ্জন সাহিত্য সাধনা করেছেন যথেষ্ট। তাঁর লেখা কাব্য গ্রন্থগুলি (সাগর সঙ্গীত, মালঞ্চ, মালা, অন্তর্যামী, কিশোর কিশোরী) সমকালে যথেষ্ট সমাদার পায়। ১৯১৪ সালে সহধর্মিনী বাসন্তী দেবীর উৎসাহে তিনি প্রকাশ করেন ‘নারায়ণ’ নামক বাংলা এক মাসিক পত্রিকার। বলাবাহুল্য, সাহিত্য রচনার মধ্যে দিয়েই তিনি দেশের প্রতি ভালবাসা ও ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছিলেন বরাবর।