নিজস্ব চিত্র
রাজু পারাল(বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক): কথায় বলে মাছে – ভাতে বাঙালি। বাঙালি জীবনের সঙ্গে মাছের সম্পর্ক সেই প্রাচীন কাল থেকেই। কোনওকালেই মাছ ছাড়া বাঙালির রসনা তৃপ্ত হয় না। স্বাদ ও গুণ মানের বিচারে মাছের স্থান যে কোনও প্রাণিজ প্রোটিনের চাইতে অনেক ওপরে। মাছের প্রসঙ্গ উঠলেই আসে ‘ইলিশে’র কথা (Hilsa Heritage)। আর জলের রুপোলি শস্য ইলিশের কথা বলতে গেলেই কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের বিখ্যাত সেই কবিতাটির কথা মনে পরে যায়। কবিতাটি ,
“ইলশে গুঁড়ি! ইলশে গুঁড়ি
ইলিশ মাছের ডিম।
ইলশে গুঁড়ি! ইলশে গুঁড়ি
দিনের বেলায় হিম।
হালকা হাওয়ায়
মেঘের ছাওয়ায়
ইলশে গুঁড়ির নাচ,
ইলিশে গুঁড়ির নাচন দেখে
নাচছে ইলিশ মাছ।”
বর্ষা এসে গেলেই মনে পড়ে যায় ইলিশের কথা। মাছের রাজা ইলিশ আজও বাঙালির হাতে-পাতে-ভাতে সর্বত্র। বঙ্গ সন্তানদের ইলিশপ্রেম আদি, অকৃত্রিম ও চিরন্তন। জলের রুপোলি শস্য ইলিশের গুনগান করে গেছেন সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সকলেই। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ছড়াতেও পাওয়া যায় ইলিশের বন্দনা (Hilsa Heritage)। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে রয়েছেন মাছের রানির কথা।
আরও পড়ুন: Pond Filling: শতাব্দী প্রাচীন শিবের মন্দিরের পুকুর ভরাট করার অভিযোগ মন্দির কমিটির বিরুদ্ধে
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জীবনানন্দ ইলিশ নিয়ে কোনও কবিতা না লিখে গেলেও ইলিশের নানা পদ তাঁদের ভীষণ পছন্দের ছিল। ইলিশ-বন্দনায় মাততে দেখা যেত প্রেমেন্দ্র মিত্র, প্রমথনাথ বিশী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এবং অন্যান্য বহু কবি – সাহিত্যিককেও। সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এক জায়গায় ইলিশের বর্ণনায় লিখেছেন, ‘বর্ষার মাঝামাঝি, পদ্মায় ইলিশ ধরার মরশুম চলিয়াছে। দিবারাত্রি কোনো সময়েই মাছ ধরিবার কামাই নাই।…নৌকার খোল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছ। লণ্ঠনের আলোয় মাছের আঁশ চকচক করে, মাছের নিস্পলক চোখগুলিকে স্বচ্ছ নীলাভ মণির মতো দেখায়।’
কথিত আছে, কবি নির্মলেন্দু ঢাকার রাস্তায় একাকী গভীর রাতে ঘুরতে বেরুলে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। তখন তিনি নাকি ছড়া কেটে ‘ইলিশ’ আর ‘পুলিশে’র প্রশংসা করে সে যাত্রায় বেঁচে যান। তিনি তাৎক্ষণিক মজার যে ছড়াটি কেটেছিলেন, ‘মাছের রাজা ইলিশ, মানুষের রাজা পুলিশ’! তবে স্বীকার করতেই হয় রূপসি ইলিশের সাতকাহন বাঙালির চাইতে আর কেই বা বেশি জানেন? ইলিশ কেবল খাদ্য নয়। এটি বাঙালির আবেগ, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা বাঙালির খাদ্যতালিকায় একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে (Hilsa Heritage)।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। পদ্মার ইলিশ স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয়। সামুদ্রিক এই মাছটি ডিম পাড়ার জন্য বাংলাদেশ ও পূর্ব ভারতের নদীগুলিতে ঝাঁকে ঝাঁকে আসে। আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও অসম, ত্রিপুরা ও ওড়িশায় এই মাছ অত্যন্ত জনপ্রিয়। পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ উভয় দেশের বাঙালিরা তাদের অসংখ্য উৎসব – অনুষ্ঠানে ইলিশ মাছকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। অর্থনৈতিক দিক থেকেও ইলিশ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটি মাছ। যদিও অতিরিক্ত চাহিদার জন্য এই মহার্ঘ মাছটি আজ বিপন্নের মুখে।
Bangla Jago FB Page: https://www.facebook.com/share/193NB43TzC/
ইলিশ সংস্কৃতি বিশ্বের অনান্য দেশের খাদ্যসংস্কৃতি থেকে পৃথক করেছে গর্বের বাঙালিয়ানাকে। স্বাস্থ্যরক্ষায় জুড়ি মেলা ভার এই ইলিশ মাছের। চোখ, ফুসফুস ও মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে, বাতের ব্যথা উপশমে, অবসাদ ও দুর্বলতার মোকাবিলায়, শিশুদের হাঁপানি প্রতিরোধে ইলিশের চাইতে উপকারী আর কোনও মাছের নাম করা যাবে না। এছাড়া হার্টের অসুখ, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, অ্যানেমিয়া, ডিমনশিয়া, ক্যানসার ইত্যাদি বহু রোগের পথ্য হতে পারে ইলিশ মাছ। তবে, বেশি খাওয়ার লোভ সামলাতে না পারলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
ইলিশ মাছের কোনও কিছুই বাদ যায় না। পেটি, ল্যাজা, মুড়ো, তেল, কানকো, কাঁটা, ডিম এ সবই খাদ্যরসিক বাঙালির কাছে প্রিয়। ভাজা, ঝাল, টক, ভাপা, ঝোল ইত্যাদি অসংখ্য উপায়ে রসসিক্ত করা পদের উৎস এই মাছ। সর্ষে – ইলিশ, ইলিশ – পাতুরি, কচু – ইলিশ এসবের নাম করলেই জিভে জল না এসে পারে না। খিচুড়ির সঙ্গে ইলিশ, পান্তা ভাতে ইলিশ যে কোনও মানুষকে জাগায় স্বর্গীয় স্বাদ। কথায় বলে, দই ইলিশ না খেলে নাকি জীবনটাই বৃথা যায়।
স্বামী বিবেকানন্দের ছিল ইলিশ মাছের প্রতি আত্মিক টান। তাঁর প্রিয় খাবার ছিল পুঁই শাক (মালবার পালং শাক) দিয়ে তৈরী ইলিশ (Hilsa Heritage)। বিখ্যাত বাঙালি লেখক শঙ্কর স্বামীজির উপর যে দুটি বই লিখেছেন – ‘আহারে অনাহারে বিবেকানন্দ’ এবং ‘অচেনা অজানা বিবেকানন্দ’ তাতে মূলত স্বামীজির ইলিশ প্রীতির উল্লেখ পাওয়া যায়।
প্রবন্ধ শেষ করি লেখিকা সেলিনা সাথী’র একটি কবিতা দিয়ে। কবিতাটি :
“ইলিশ ইলিশ চারদিকে
ছড়ায় শুধু ঘ্রান
একটা ইলিশ পেতাম যদি
জুড়িয়ে যেতো প্রাণ।”
বাঙালির ইলিশ প্রীতির কথা ভেবে বলতে ইচ্ছা করে, বাঙালি ইলিশে থাক, ইলিশে বাঁচুক।
( লেখক – বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক)