গ্রাফিক্স: নিজস্ব
মহম্মদ মফিজুল ইসলাম: হে অরণ্য! তুমি পৃথিবীর প্রথম বাসিন্দা, সভ্যতার জন্মদাতা (Green Earth)। তোমার বুকে দাঁড়িয়ে মানুষ শিখেছে বাঁচতে, জাগতে, ভাবতে। তোমার ছায়াতলে আর্য ঋষিগণ রচনা করেছেন উপনিষদের মতো অমর জ্ঞান। তোমার প্রতিটি পত্রে, শাখায়, গন্ধে, সুরে মিশে আছে মানবজাতির অস্তিত্ব। আজ সেই তুমিই পরিণত হয়েছ নিঃস্ব এক আর্তনাদে।
সভ্যতার অন্ধ গতির যাত্রী মানুষ আজ ভুলে গেছে—
সবুজ ছাড়া জীবন কেবলই মরুভূমি। মানুষের লোভ, আধুনিকতার মোহ এবং স্বার্থপর উন্নয়নের অজুহাতে পৃথিবীর হৃদয় থেকে ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে বনভূমি। বন, যাকে আমরা একদিন মা বলে জেনেছি, আজ তারই বুক কেটে তৈরি করছি কংক্রিটের নগর।
[আরও পড়ুন: WB WEATHER: দাবদাহের মাঝে স্বস্তির বার্তা, সপ্তাহান্তে দক্ষিণবঙ্গে ঢুকতে পারে বর্ষা]
বিজ্ঞানের অগ্রগতি বনাম প্রকৃতির সহাবস্থান—
একবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে আমরা গর্বিতভাবে বলেছিলাম— “এই হবে সবুজ বিপ্লবের শতক।” অথচ দুই দশকের মধ্যেই সেই আশার সবুজ রং মলিন হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ১ কোটি হেক্টর বনভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। FAO-এর (Food and Agriculture Organization) ২০২৩ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিগত ৩০ বছরে বিশ্বে মোট বনভূমির ১০ শতাংশ হারিয়ে গিয়েছে।
ভারতবর্ষে অবস্থা আরও করুণ। উত্তরবঙ্গ থেকে শুরু করে উত্তর-পূর্বাঞ্চল, মধ্যভারতের গভীর অরণ্য— সবখানেই চলছে ‘উন্নয়ন’ নামক বনহত্যা। মাত্র এক দশকে ভারতের বনভূমির পরিমাণ কমেছে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন হেক্টর। রেল প্রকল্প, নদী-সংযুক্তিকরণ, খনি প্রকল্প, শিল্পপার্ক—সব কিছুর পেছনে কাটা পড়েছে হাজার হাজার বছরের পুরনো অরণ্য (Green Earth)।
বাংলার হৃদয়েও আজ কাঁদছে অরণ্য (Green Earth)। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অনেকদিন আগে থেকেই বিপন্ন। ঘূর্ণিঝড় ইয়াস, আমফান, বুলবুল— এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে হলে দরকার ছিল সবুজের প্রাচীর। অথচ সুন্দরবনের প্রান্তে দেদার চলছে চিংড়ি চাষ, হোটেল নির্মাণ, এবং বেআইনি বসতি গড়ে তোলার কাজ।
অন্যদিকে, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে প্রতিনিয়ত চলছে পাথর কোয়ারির দাপট। আদিবাসী মানুষের জীবন-জীবিকা যেমন ধ্বংস হচ্ছে, তেমনই হুমকির মুখে পড়ছে জীববৈচিত্র্য। তবে আশার কথা, বর্তমান রাজ্য সরকার এগুলি কোনও ভাবেই বরদাস্ত করছে না। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে সুন্দরবনকে আরও ‘সুন্দর’ করতে কোটি কোটি ম্যানগ্রোভ লাগানো হয়েছে। যাতে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ-শৃঙ্খল আরও সুদৃঢ় হয়। সেই সঙ্গে বেআইনি হোটেল বা অন্যান্য নির্মাণে রাশ টানা হয়েছে। মানব সভ্যতা বাঁচাতে আর কোনও উপায় ছিল না। ফলে সরকারি এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে সাধুবাদযোগ্য।
মানবিক বিপর্যয়ের প্রতিচ্ছবি– বন শুধু গাছ নয়, তা এক জীবনচক্র। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজারও আদিবাসী গোষ্ঠীর সংস্কৃতি, ইতিহাস, আত্মপরিচয়। জল, হাওয়া, ওষুধ, ছায়া, খাদ্য— এই সব কিছুর মূল উৎস যদি ধ্বংস হয়, তা হলে মানুষ কোথায় যাবে? মানুষের নির্মিত নগর কি পারে পাখির আশ্রয় দিতে? মাটির গভীরে কি প্রোথিত থাকবে শিল্পকলার শিকড়?
আজ আমরা ভুগছি—
প্রচণ্ড উষ্ণতা– ২০২৪ সাল ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম উষ্ণতম বছর। ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে তাপমাত্রা ছাড়িয়ে যায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জলসংকট– বনভূমি কাটা মানে জলধারার উৎস বিনষ্ট। খাল, বিল, নদী শুকিয়ে যাচ্ছে।
জীববৈচিত্র্যের সংকট: WWF ( World Wide Fund for Nature) -এর ২০২২ সালের রিপোর্ট জানায়, গত ৫০ বছরে বিশ্বের প্রাণীর সংখ্যা গড়ে ৬৯ শতাংশ কমে গিয়েছে।
এই সংকট কেবল প্রকৃতির নয়, মানুষের অস্তিত্বের প্রশ্ন। অরণ্য কেটে সভ্যতা গড়ে তুললেও, সভ্যতার সেই বিকৃত অবয়ব শেষ পর্যন্ত নিজের অস্তিত্বকেই গ্রাস করছে।
নাগরিক জীবনের বন্দিত্ব ও সবুজের তৃষ্ণা–
আজকের মানুষ চার দেওয়ালের মধ্যে নিজেকে বন্দি করে ফেলেছে। কংক্রিটের ছাদে শিশুরা জানে না কাকের ডাক, গাছের ছায়া কিংবা পিঁপড়ের সারি। নগরের বিষাক্ত বাতাসে ছড়াচ্ছে অ্যাজমা, ক্যান্সার, মানসিক অবসাদ। যান্ত্রিক জীবনের দমবন্ধ পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে তাই মানুষ ফিরে যেতে চাইছে প্রকৃতির কোলে।
জানালার বাইরে তাকিয়ে একফোঁটা সবুজ খোঁজে সে, ছুটির দিনে পাহাড়, সমুদ্র বা জঙ্গলের দিকে দৌড়ায়, কারণ সে জানে— অরণ্য মানেই মুক্তি। অরণ্য মানেই শান্তি। অরণ্য মানেই মানুষ হওয়ার পুনর্জন্ম। প্রতিকার, দায় এবং দায়বদ্ধতা– এই ধ্বংসযজ্ঞ থামানো এখনও সম্ভব— শুধু চাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সামাজিক উদ্যোগ, এবং ব্যক্তিগত সচেতনতা।
FB POST: https://www.facebook.com/share/p/1AwDqqR66j/
কী করতে পারি আমরা?
(১) প্রতিটি কাটা গাছের পরিবর্তে অন্তত তিনটি গাছ রোপণ (Green Earth) করুন।
(২) পরিত্যক্ত জমিতে গড়ে তুলুন সবুজ অঞ্চল।
(৩) শহরে ছাদ বাগান ও উর্বর বেষ্টনী গড়ে তুলুন।
(৪) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘এক ছাত্র এক গাছ’ কর্মসূচি চালু করুন।
(৫) প্রকৃতির পক্ষে জোরালো জনমত তৈরি করুন সামাজিক মাধ্যমে।
(৬) অরণ্যের অধিকার নিয়ে নীতিনির্ধারক মহলে চাপ সৃষ্টি করুন।
এক পুনর্জন্মের আহ্বান– মানুষ ভুল করেছে, নিঃসন্দেহে করেছে। কিন্তু এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত সম্ভব– গাছ পুঁতে, অরণ্য বাঁচিয়ে, প্রকৃতিকে ভালবেসে।
আমরা কি পারি না অরণ্যকে (Green Earth) ফিরিয়ে দিতে তার প্রাপ্য সম্মান? পারি না কি ফের একবার উপনিষদের মতো মহাজ্ঞানের বীজ বুনতে অরণ্যের হৃদয়ে? আজ আমাদের সবুজকে রক্ষা করার লড়াই, ভবিষ্যতের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। দাও ফিরে সে অরণ্য, যে অরণ্যে মানুষ ছিল প্রকৃতির সন্তান, যেখানে সভ্যতা মানে ছিল সহাবস্থান, আর প্রকৃতি ছিল আমাদের প্রার্থনার প্রথম নাম।