গ্রাফিক্স: নিজস্ব
Bangla jago Desk: ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের ফলে সুন্দরবন ও দু’ভাগে বিভক্ত হয়েছে। অবিভক্ত বাংলায় সুন্দরবনের আয়তন ছিল ২৫,৫০০ বর্গ কিলোমিটার। দেশভাগের পরে বাংলাদেশের ভাগে পড়ে সুন্দরবনের ১৫,৮৭০ বর্গ কিলোমিটার (৬০ শতাংশ) আর ভারতের পশ্চিমবঙ্গে রয়ে যায় ৯,৬৩০ বর্গ কিলোমিটার (৪০ শতাংশ)। ব্রিটিশ সরকারের মতো স্বাধীনতা পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গ সরকারও নদীমাতৃক, ম্যানগ্রোভ অরণ্য সমৃদ্ধ সুন্দরবন অঞ্চলকে বিশেষ সম্ভাবনাময় বলে মনে করেছিল। সেই সময় সুন্দরবনে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটার অভাব ছিল তা হল পরিকাঠামো। সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশের অঙ্গরাজ্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ আর্থিক ভাবেও ছিল বেশ দুর্বল। ফলে অঞ্চলের পরিকাঠামো উন্নয়নের পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করা ছিল বেশ কঠিন কাজ। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও ১৯৪৮ সালে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় ২৪ পরগনা ও সুন্দরবনের উন্নয়ন নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করেন। যার মধ্যে প্রথমেই ছিল সুন্দরবনকেন্দ্রিক একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা। এই কর্মপরিকল্পনার সফল রূপায়ণের জন্য গঠন করা হয় ‘সুন্দরবন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’ (Dr Bidhan Chandra Roy)।
আরও পড়ুনঃ Migrant Workers: পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে তৃণমূল, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির বিরুদ্ধে লড়াই আদালতে
দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জেলার মতো ২৪ পরগনাতেও উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এই অঞ্চলে পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে সরকার যে জমিগুলি চিহ্নিত করেছিল সেগুলি ছিল মূলত খাস জমি। এর ফলে বেশ কিছু খাস জমি যা কিনা পতিত হয়ে পড়ে ছিল সেখানে বহু উদ্বাস্তু পরিবারকে পুনর্বাসন দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। প্রথমে সরকারি ভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল সুন্দরবনের জঙ্গল সংলগ্ন অঞ্চল বাদ দিয়ে ২৪ পরগনার আধা মফস্বল এলাকা যেমন– সোনারপুর সংলগ্ন লস্করপুর, রামচন্দ্রপুর, মেদিয়া, ক্যানিং, কুলপির মতো জায়গায় উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন দেওয়া হবে। পরবর্তী কালে জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপে ঝড়খালি, হেড়োভাঙার মতো জঙ্গল লাগোয়া এলাকাও পুনর্বাসন প্রকল্পের আওতায় চলে আসে। মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের কার্যকালে ক্যানিং ও হেড়োভাঙা অঞ্চলে ১১ হাজার একর পতিত জমি উদ্ধারের কর্মসূচি নেওয়া হয়। সেই সময় নতুন জমি উদ্ধারের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে ছিল। এই কাজের জন্য উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের দফতরে অবনীকুমার বন্দোপাধ্যায় ও বিমলাকান্ত লাহিড়ি নামক দু’জন স্পেশ্যাল অফিসার নিয়োগ করা হয়। এসবই সম্ভব হয়েছিল ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের ঐকান্তিক উদ্যোগের ফলে (Dr Bidhan Chandra Roy)।
সেই সময় জমির চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জমির মূল্য বাড়ার ও একটা সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় এ বিষয়ে অবহিত ছিলেন, এবং এই সম্ভবনার জন্য পশ্চিমবঙ্গ ভূমি উন্নয়ন ও পরিকল্পনা বিধি নামক একটি নতুন বিধি বিধানসভায় পাশ করিয়ে নিয়েছিলেন। এই আইন প্রণয়ন করার জন্য যে বোর্ড গঠন করা হয়েছিল তার সভাপতি ছিলেন স্বয়ং ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। ২৪ পরগনার সোনারপুর থানার লস্করপুর গ্রামে কয়েক জায়গায় ইটভাটা গড়ে উঠেছিল। এই বিধি পাশ হওয়ার পর ভূমি উন্নয়ন বোর্ড মনে করেছিল ইটভাটা অন্য কোথাও স্থানান্তরিত করলেও চলবে, কিন্তু যারা অকৃষিজীবী উদ্বাস্তু তাদের জন্য কলকাতা সংলগ্ন এই অঞ্চলে জমি সংগ্রহ করা বাঞ্ছনীয়। কারণ এখানে পুনর্বাসন পেলে তাদের জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রে সুবিধা হবে। সুন্দরবনের মানুষকে আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী করতে ও সুন্দরবন অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নের স্বার্থে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে ‘সুন্দরবন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’ পুরোদমে কাজ করে চলেছিল। কিন্তু সীমিত পরিকাঠামো ও লোকবল নিয়ে বৃহৎ আয়তনের ২৪ পরগনা জুড়ে বেশি দিন কাজ করা সম্ভব হয়নি ‘সুন্দরবন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’র। এই অভিজ্ঞতা থেকেই ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় ২৪ পরগনা জেলাকে দু’টি ভাগে ভাগ করার চিন্তা ভাবনা শুরু করেন। ঠিক হয় উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা কে দু’ভাগে ভাগ করা হবে। বনগাঁ, বসিরহাট, বারাসত, ব্যারাকপুর এই ৪টি মহকুমা নিয়ে গঠিত হবে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা। অন্যদিকে, দক্ষিণের সদর ডায়মন্ড হারবার মহকুমাকে ভাগ করে দু’টি মহকুমা গঠনের কথা বলা হয়। এগুলি হল জয়নগর ও কাকদ্বীপ (Dr Bidhan Chandra Roy)।
Bangla Jago fb page: https://www.facebook.com/share/193NB43TzC/
এছাড়া প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে বড় থানাগুলিকে ভাগ করে নতুন কয়েকটি থানা তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সমগ্র সুন্দরবন অঞ্চলকে প্রশাসনিক ভাবে একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনাই ছিল এর একমাত্র লক্ষ্য। এই পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে ১৯৫৯ সালে সমগ্র ২৪ পরগনায় ১৭টি নতুন থানা গঠন করা হয়। সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামগুলিতে যাতে পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছে যায়, সে বিষয়েও উদ্যোগ নিয়েছিলেন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। ১৯৫০ সালে সরকারি সহায়তায় সুন্দরবনের একাধিক গ্রামে ২৩টি নলকূপ বসানো হয়। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের মুখ্যমন্ত্রিত্ব কালে পশ্চিমবঙ্গ বনভূমি উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট স্ট্যাটিক্স-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৯৫১-৫২ থেকে ১৯৫৫-৫৬ পর্যন্ত যে পরিকল্পনা নেওয়া হয় সেখানে রাজ্যের অধীনে বনভূমির পরিমাণ ছিল ০.৭৮ শতাংশ, দ্বিতীয় পরিকল্পনা ১৯৫৬-৫৭ ও ১৯৬০-৬১ অনুযায়ী বনভূমির পরিমাণ কিছুটা বেড়ে হয় ১.০০ শতাংশ, এবং তৃতীয় পরিকল্পনা ১৯৬১-৬২ ও ১৯৬৫-৬৬ অনুযায়ী ফরেস্ট সেক্টরের পরিমাণ হয় ৬.৮৫ শতাংশ (Dr Bidhan Chandra Roy)।
বর্ধিত বনভূমির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারের তরফ থেকে নিয়মিত অর্থ বরাদ্দ করা হতো। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় দেশভাগ জনিত পরিস্থিতিতে পূর্ব বাংলা থেকে আগত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য কখনওই সুন্দরবনের বনভূমি সংলগ্ন দ্বীপগুলি নির্বাচন করেননি। কারণ তিনি চাননি জনবসতির চাপে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশের কোনও ক্ষতি হোক। যদিও ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে ২৪ পরগনা জেলা ভাগের পরিকল্পনা সফল হয়নি। তবুও তাঁর সুন্দরবন উন্নয়নের ভাবনাও পরিকল্পনাকে অস্বীকার করা যায় না। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় তাঁর সুন্দরবন উন্নয়নের পরিকল্পনা থেকে সরে আসেননি। কারণ, তিনি মনে করতেন সুন্দরবনের উন্নয়ন সেখানকার মানুষ, বনভূমি, ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে একান্ত প্রয়োজন (Dr Bidhan Chandra Roy)।