ad
ad

Breaking News

Assam

বিজেপি আমাদের ‘আমার সোনার বাংলা’ও গাইতে দেবে না?

এর আগে কখনও মেঘালয়ের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিককে শুধুমাত্র মুসলিম হওয়ার জন্য গ্রেফতার করেছেন, কখনও মুসলিমদের রুখতে হিন্দুদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার আইন আনার কথা বলেন, তিনি এবারে রবীন্দ্রনাথের গানের উপর ‘খড়্গহস্ত’।

Assam Congress Leader Arrested for Singing ‘Amar Shonar Bangla’

চিত্র: সংগৃহীত

সুমন ভট্টাচার্য (বিশিষ্ট সাংবাদিক): প্রবীণ সাংবাদিক রন্তিদেব সেনগুপ্তর সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টটা দেখে চোখে জল চলে আসছিল। অসমের (Assam) মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা, যিনি উত্তর-পূর্ব ভারতে বিজেপির নতুন ‘পোস্টার বয়’, এবং যিনি মাঝে মাঝেই নিজেকে বিজেপির ‘নম্বর ২’ অর্থাৎ অমিত শাহ ভাবেন, তিনি আসামের পঁচাশি বছর বয়সি কংগ্রেসের নেতা শ্রীবিধুভূষণ দাসকে গ্রেফতার করেছেন ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়ার জন্য। কারণ, হিমন্ত বিশ্বশর্মা, যিনি এর আগে কখনও মেঘালয়ের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিককে শুধুমাত্র মুসলিম হওয়ার জন্য গ্রেফতার করেছেন, কখনও মুসলিমদের রুখতে হিন্দুদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার আইন আনার কথা বলেন, তিনি এবারে রবীন্দ্রনাথের গানের উপর ‘খড়্গহস্ত’।

তিনি অসমের (Assam) ওই কংগ্রেস নেতাকে জেলে পাঠিয়েছেন শুধুমাত্র ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়ার জন্য। কারণ, হিমন্ত বিশ্বশর্মার মতে ওই গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। তাই কোনও ভারতীয় গাইলেই তিনি আসলে ‘বাংলাদেশি’। যে মুখ্যমন্ত্রী, ভারতবর্ষের যে মুখ্যমন্ত্রী ভারতের জাতীয় সঙ্গীত রচয়িতা, এখনও পর্যন্ত ভারত থেকে একমাত্র সাহিত্যে নোবেল পাওয়া সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের লেখা গান গাওয়ার জন্য কাউকে জেলে পাঠাতে পারেন, তাঁকে কী বলবেন? তাহলে আমাদের বুঝে নেওয়া উচিত এই ‘সার’-এর পরিবেশে, বাঙালিকে ‘বাংলাদেশি’ বলে দেগে দেওয়ার আবহে আসলে বিজেপি ঠিক কী চায়?

রন্তিদেব সেনগুপ্ত, যিনি প্রবীণ সাংবাদিক, মাঝে কিছু দিন আরএসএস-এর ‘স্বস্তিকা’ পত্রিকারও সম্পাদক ছিলেন, তিনি যখন আজকে ‘দেশ বাঁচাও গণমঞ্চ’ সংগঠনের হয়ে বিভিন্ন জায়গায় আরএসএস এবং বিজেপির বিরুদ্ধেই প্রচার করে বেড়াচ্ছেন, তখন তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টটি চোখে জল এনে দেয়। বাঙালিকে কোথায় নামতে হয়েছে, যে শেষ পর্যন্ত ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়ার জন্য একজন অসমের (Assam) কংগ্রেস নেতাকে জেলে পাঠানো হচ্ছে! সুখের কথা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার বিধান ভবন থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে শনিবারই কলকাতায় এর প্রতিবাদে মিছিল করেছেন।

এর আগে বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্য ‘বাংলা বলে কোনও ভাষাই নেই’ বলেছেন। পরেশ রাওয়াল, যিনি বিজেপির আর এক সাংস্কৃতিক মুখ, যাঁকে মাঝে মাঝেই অনেকে আবার ‘অন্য চোখে’ দেখেন, সেই পরেশ রাওয়াল, বিজেপির সাংসদ মাছ খেলেই ‘বাংলাদেশি’ বলে দেগে দিতে চেয়েছিলেন। এই সমস্ত অত্যাচার, অপমান, লাঞ্ছনার মধ্যে বাঙালি নিজের মতো করে লড়াই দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু রন্তিদেব সেনগুপ্ত তাঁর ফেসবুক পোস্টে যে কথাটি বলেছেন সেটা সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ।

যদি ‘আমার সোনার বাংলা’ এই গানটি গাওয়ার জন্য ভারতবর্ষের কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কোনও মানুষকে জেলে পাঠাতে পারেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে কলকাতায় প্রতিবাদ হবে না? কলকাতার যে ‘প্রতিবাদী’ সাংস্কৃতিক কর্মীরা, যাঁরা নন্দন চত্বরে অন্য সময় ঢিল পড়লেও প্রতিবাদে সরব হন, তাঁরা হিমন্ত বিশ্বশর্মার বিরুদ্ধে কেন প্রতিবাদে সরব নন? নাকি আসামে সাহিত্য উৎসবে ডাক পাওয়ার, নাকি শিলচরে গিয়ে কবিতা আবৃত্তি করে আসার প্রলোভন এত তীব্রতর, যে হিমন্ত বিশ্বশর্মার এহেন ‘দুঃসহ স্পর্ধা’ দেখার পরও কেউ কোনও প্রতিবাদ করছেন না!

কলকাতার আনাচে-কানাচে, বালুরঘাট থেকে বনগাঁ অবধি বিভিন্ন মঞ্চে প্রতিদিন অন্তত হাজারখানেক মানুষ কবিতা পড়েন। তাঁদের কি একবারও লজ্জাও হচ্ছে না, যে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়ার অপরাধে, তাও আবার ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়ার অপরাধে আসামের একজন কংগ্রেস নেতাকে জেলে পাঠানো হচ্ছে? এবং হিমন্ত বিশ্বশর্মা দেগে দিচ্ছেন, যে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইলে তিনি ‘বাংলাদেশি’! কলকাতায় যাঁরা কবিতা পড়েন, বাংলা একাডেমি থেকে শুরু করে অলিতে-গলিতে, আনাচে-কানাচে যাঁরা গলায় উত্তরীয় জড়িয়ে সম্বর্ধনা নেন, সেইসব কবিদের কি একবারও ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে না, যে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়ার জন্য যদি কাউকে জেলে যেতে হয়, তার বিরুদ্ধে অন্তত মুখ ফুটে প্রতিবাদ করতে হবে (Assam)?

বাঙালি জাতি, বাঙালির অস্তিত নিয়ে এর চাইতে বড় টানাটানির পর কবে বাঙালি প্রতিবাদ করতে শিখবে? রন্তিদেব সেনগুপ্ত ঠিক কথা লিখেছেন। যদি এর প্রতিবাদে কোনও মিছিল হয় তিনি রাস্তায় নামবেন। হয়তো আমিও নামব। হয়তো কেন, নিশ্চিতভাবেই নামব। কারণ, এই অপমান, এর চাইতে বড় অসম্মান রবীন্দ্রনাথকে করার সাহস আর কেউ দেখাননি। হিমন্ত বিশ্বশর্মা যা বলেছেন, তারপরে যদি বাঙালি প্রতিবাদে গর্জে না ওঠে, তাহলে বুঝে নিতে হবে, যে বিজেপি আমাদের মাথায় চেপে বসেছে।

গত বছরের আর জি কর আন্দোলনের সময় থেকে আমি বারবার মনে করি এবং বলি, লিখিও, যে বাঙালির প্রতিবাদ আন্দোলনটা বড্ড শহুরে ‘এলিট’ এবং ‘বাজারি মিডিয়া’র নিয়ন্ত্রণাধীন। অর্থাৎ, ‘বাজারি মিডিয়া’ যে খবরকে গুরুত্ব দেবে বা যে খবরের প্রতিক্রিয়া দিলে ‘বাজারি মিডিয়া’র টেলিভিশন চ্যানেলে ডাক পাওয়া যাবে, সেটাই বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা আউড়ে যান। তার বাইরে ‘বাঙালি অস্মিতা’র প্রশ্নে, যেখানে বাঙালির অস্তিত্ব সত্যি সত্যি বিপন্ন, সেখানে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা খুব একটা কথা বলেন না। বরং, আজকাল টেলিভিশন চ্যানেলে গিয়ে কোনও কোনও বাঙালি বুদ্ধিজীবী, যাঁদের ‘বাজারি প্রতিভা’ বলা যায়, তাঁরা এমন ‘ইসলাম বিদ্বেষ’ উগড়ে দিয়ে আসেন, যে ভয় হয়, যে সুযোগ পেলে তিনি দাঙ্গার সময় কাটারি হাতে বেরিয়ে না পড়েন (Assam)!

কিন্তু যখন রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করা হয় শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের বাংলা গান গাওয়ার জন্য, ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়ার জন্য কাউকে জেলে যেতে হয়, তখন এইসব ‘বাজারি প্রতিভা’, ‘বাজারি ইনফ্লুয়েন্সার’, ‘বাজারি বুদ্ধিজীবী’দের দেখাই পাওয়া যায় না! তাঁরা এমন ‘হিরণ্ময় নীরবতা’য় থাকেন, যে দেখলে সন্দেহ হয়, যে তাঁরা জানেন কিনা ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের ইতিহাস কোথা থেকে শুরু? কেন ‘আমার সোনার বাংলা’ বাঙালির ইতিহাসে এত গুরুত্বপূর্ণ? সেটা জানে না বলেই বোধহয় এইসব করেও এত সহজে পার পেয়ে যেতে পারেন।

আবারও বলছি, হিমন্ত বিশ্বশর্মা যে দুঃসাহস দেখিয়েছেন, সেই দুঃসাহসের প্রতিবাদ করা বাঙালি হিসেবে প্রথম কর্তব্য। তবু সুখের বিষয় তৃণমূল ছাত্র পরিষদ এবং যুব কংগ্রেসের অনেকে এই চমৎকার সব ভিডিও বানিয়েছেন। সীমান্তে থাকেন বলেই বোধহয় বনগাঁর প্রসঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভিডিওটি এত ভাইরাল হয়েছে (Assam)।

তিনি যে ভিডিয়ো বানিয়েছেন, তা কয়েক হাজার মানুষ দেখেছেন। কিন্তু তার বাইরে বৃহত্তর বাঙালি সমাজের প্রতিবাদ কোথায়? ‘বাজারি’ সংবাদপত্রে এখন কেন ‘উত্তর সম্পাদকীয়’র ঢেউ নেই? কেন নেই আলোচনা, সন্ধ্যাবেলা খাপ পঞ্চায়েত বসানো বা ‘ঘণ্টা খানেক’-এর আলোচনা? আসলে এর থেকে খুব একটা ‘বাজারি মিডিয়া’ প্রচার দেবে কিনা সেটা বোঝা যাচ্ছে না বলেই আপাতত রবীন্দ্রনাথ ‘খলনায়ক’ এবং হিমন্ত বিশ্বশর্মা মোটামুটি ‘সিকান্দার’।

যে প্রদেশ কংগ্রেস দফতর, অর্থাৎ বিধান ভবনে বসে কংগ্রেসের কাউন্সিলার এবং অন্য অবাঙালি নেতারা বাংলা পক্ষের গর্গ চট্টোপাধ্যায় এবং কৌশিক মাইতিকে মারধোর করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল, সেই প্রদেশ কংগ্রেস দফতরের বর্তমান নেতা, অর্থাৎ, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার যে এই কঠিন সময়ে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের সমর্থনে কলকাতায় মিছিল করেছেন, এইজন্য তাঁকে কুর্নিশ। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে যে দলটির সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন, রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি আরও অনেক কিছু জড়িয়ে আছে, তাঁরা যে শেষ পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পেরেছেন, এটাই সবচেয়ে বড় বিষয়।

অন্তত বাংলা পক্ষের সঙ্গে কংগ্রেসের অবাঙালি নেতাদের হাতাহাতির মতো বিতর্কে শুভঙ্কর সরকার নিজেকে আটকে রাখেননি। সেটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ, যে বাঙলির তথাকথিত ‘এলিট নাগরিক সমাজ’, তথাকথিত ‘এলিট’ বুদ্ধিজীবীকুল, তথাকথিত ‘এলিট’ কলকাতার সংবাদপত্রগুলি কীভাবে ‘রিয়্যাক্ট’ করছে (Assam)।

‘রিয়্যাক্ট’ মানে ‘প্রতিক্রিয়া’, যে ‘প্রতিক্রিয়া’ রবীন্দ্রনাথের জন্য আমাদের কাছে প্রত্যাশিত, যে ‘প্রতিক্রিয়া’র জন্য আমরা অপেক্ষা করে থাকি। আমরা ভাবি, যে অন্তত কলকাতা শহরের বুদ্ধিজীবীকুল তো বুঝতে পারছে, যে কী হতে চলেছে। দুঃখের কথা, যে এখনও অবধি বাঙালি বুদ্ধিজীবীকুলের, যাঁরা অন্যসময় ভেনেজুয়েলা থেকে গাজা অবধি বিষয় নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন, তাঁরা এই বিষয়ে এখনও মুখ খোলেননি।

আবার বলছি, অসম সরকার, বিশেষ করে হিমন্ত বিশ্বশর্মা গত কয়েক বছরে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের আমন্ত্রণ করে আসামে নিয়ে গিয়ে সাহিত্য উৎসবে গলায় গামছা দিয়ে যে কৃতজ্ঞতা ঋণে বেঁধে রেখেছেন, তাই জন্য তাঁদের কাছে রবীন্দ্রনাথের চাইতে হিমন্ত বিশ্বশর্মাই বেশি কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু ক্যানিং থেকে কোচবিহারের বাঙালি রবীন্দ্রনাথকেই চেনেন, এখনও হিমন্ত বিশ্বশর্মাকে গুরুত্ব দেন না। এই যে বাঙালিকে অপমান, এই যে রবীন্দ্রনাথকে অপমান, আশা করা যায় বাঙালি তার প্রতিবাদের স্বভাবসিদ্ধ পথে বিজেপিকে তা ফিরিয়ে দেবে (Assam)।