ad
ad

Breaking News

Lakshmi Worship

Lakshmi Worship: লক্ষ্মীপুজো কি শুধু ‘ধনের দেবী’র আরাধনা? নেপথ্যে লুকিয়ে থাকা শ্রম ও শৃঙ্খলার আসল দর্শন

বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই উৎসবগুলোর বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। কারণ এগুলো শুধু ভক্তি বা বিশ্বাসের প্রতিফলন নয়, বরং জীবনযাত্রার শৃঙ্খলা, শ্রম এবং সামাজিক বন্ধনের প্রতীক।

Lakshmi Worship in Bengal: Festival of Labor, Discipline

চিত্রঃ সংগৃহীত

বিশ্বজিৎ বৈদ্য: ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতিতে পুজো-পার্বণ শুধু ধর্মীয় আচার নয়, বরং সামাজিক জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই উৎসবগুলোর বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। কারণ এগুলো শুধু ভক্তি বা বিশ্বাসের প্রতিফলন নয়, বরং জীবনযাত্রার শৃঙ্খলা, শ্রম এবং সামাজিক বন্ধনের প্রতীক। লক্ষ্মীপুজো সেই উৎসবগুলির মধ্যে অন্যতম, যা বহুল প্রচলিত হলেও এর আসল তাৎপর্য অনেক সময়েই আড়ালে পড়ে যায়। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, লক্ষ্মীপুজো হল সম্পদ ও ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা। কিন্তু গ্রামীণ সমাজ ও কৃষিনির্ভর জীবনের গভীরে প্রবেশ করলে স্পষ্ট হয়, এই পুজোর মূল লক্ষ্য কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং শ্রমের মর্যাদা ও জীবনের শৃঙ্খলা রক্ষা।
বাংলার কৃষক সমাজ জানে, বছরের পর বছর পরিশ্রম ছাড়া শস্যভাণ্ডার পূর্ণ হয় না। সেই শ্রমের সম্মান জানাতে এবং নতুন শস্যকে আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করতে তাঁরা দেবী লক্ষ্মীকে আহ্বান করেন। এখানে পূজার আধ্যাত্মিক আবরণ থাকলেও অন্তর্গত দর্শন হলো শ্রমই সম্পদ, আর শৃঙ্খলাই তার রক্ষাকবচ। ফলে লক্ষ্মীপুজোকে যদি শুধুই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়, তবে তার সামাজিক ও দার্শনিক গুরুত্ব যথাযথভাবে উপলব্ধি করা যায় না।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
লক্ষ্মীদেবীর পুজোর ইতিহাস ভারতীয় সভ্যতায় প্রাচীন। বৈদিক যুগে তাঁকে ‘শ্রী’ নামে ডাকা হতো, যার অর্থ হল সৌন্দর্য, ঐশ্বর্য ও মঙ্গল। পরবর্তী কালে পুরাণে দেবী লক্ষ্মীর আবির্ভাব কাহিনি পাওয়া যায়—সমুদ্র মন্থনের সময় তিনি পদ্মফুলে আসীন হয়ে প্রকাশিত হন, দেবতাদের মধ্যে সম্পদ ও সমৃদ্ধির প্রতীক হয়ে ওঠেন। ধীরে ধীরে হিন্দু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে তিনি সর্বাধিক পূজিতা দেবীদের অন্যতম হয়ে দাঁড়ান।
কিন্তু বাংলার প্রেক্ষাপটে লক্ষ্মীপুজোর চরিত্র ভিন্ন মাত্রা লাভ করে। এখানে দেবী শুধু পুরাণের ধনসম্পদের দেবী নন, বরং কৃষিজীবী সমাজের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত এক লোকায়ত দেবী। বিশেষত আশ্বিন মাসের শারদীয় দুর্গাপুজোর পর, নতুন ধানের ফুল ধরার মরসুমে, গ্রামীণ সমাজ দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করে। এটি কেবল ভক্তিপূর্ণ ধর্মীয় আচার নয়, বরং একটি ফসলোৎসব বা হারভেস্ট ফেস্টিভ্যালের মতো, যেখানে কৃষকরা তাঁদের কঠোর পরিশ্রমের ফলকে দেবীর কাছে নিবেদন করেন।

আরও পড়ুনঃ জয়পুরে হাসপাতালে আগুন, রোগীদের ছেড়ে পালালেন হাসপাতালের কর্মীরা!

শাস্ত্রীয় দেবী বনাম লোকায়ত রূপ
হিন্দু শাস্ত্র ও পুরাণে দেবী লক্ষ্মী মূলত ধন, ঐশ্বর্য ও সৌভাগ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তিনি বিষ্ণুর অর্ধাঙ্গিনী, বৈকুণ্ঠের শ্রী, পদ্মফুলে আসীন এবং স্বর্গীয় ঐশ্বর্যের প্রতীক। পুরাণকথায় তাঁর আবির্ভাব ঘটে সমুদ্র মন্থনের সময়, যেখানে তিনি দেবতা-অসুর উভয়ের আকাঙ্ক্ষিত রূপে প্রকাশিত হন। এই শাস্ত্রীয় রূপে লক্ষ্মী মানে ধনসম্পদ, রাজ্যশক্তি ও সৌভাগ্য।
কিন্তু বাংলার লোকসংস্কৃতিতে দেবী লক্ষ্মীর চিত্র ভিন্ন। এখানে তিনি আর রাজপ্রাসাদের দেবী নন, বরং কৃষিজীবী সমাজের গৃহস্থালির কেন্দ্রীয় প্রতীক। তাঁর পূজা হয় ধান, শস্য, আলপনা, গোবরের লেপা মাটি, ধূপ-প্রদীপ, আর গৃহিণীর শ্রম দিয়ে। বাংলার গ্রামে প্রচলিত আছে—যে ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নয়, যেখানে অপচয় বা অগোছালো জীবনযাপন হয়, সেখানে দেবী প্রবেশ করেন না। এই বিশ্বাস আসলে শ্রম ও শৃঙ্খলার সামাজিক মূল্যবোধকেই দেবীর মাধ্যমে প্রতীকায়িত করেছে।
এখানে লক্ষ্মীকে কেবল ‘ধনের দেবী’ হিসেবে দেখা হয় না, বরং তাঁকে বলা হয় ‘গৃহলক্ষ্মী’—অর্থাৎ ঘর-সংসারের সুশৃঙ্খল রক্ষক। বাংলার গৃহিণীকে প্রায়ই ‘লক্ষ্মীছোঁয়া’ বা ‘লক্ষ্মীমন্ত’ বলে অভিহিত করা হয়, যা বোঝায় যে সংসারে শ্রম, মিতব্যয়িতা এবং পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখাই আসল ঐশ্বর্য।
ফলে দেখা যায়, শাস্ত্রীয় লক্ষ্মী যেখানে ঐশ্বর্য ও রাজসভার প্রতীক, বাংলার লোকায়ত লক্ষ্মী সেখানে সাধারণ গৃহস্থালির শৃঙ্খলা, পরিশ্রম ও সঞ্চয়ের প্রতীক। এই পার্থক্যই লক্ষ্মীপুজোর আসল তাৎপর্যকে ধর্মীয়তার গণ্ডি থেকে বের করে এনে জীবনযাত্রার অংশ করে তুলেছে।

গ্রামীণ সমাজে শ্রমের আরাধনা

বাংলার গ্রামীণ সমাজে লক্ষ্মীপুজো একেবারেই কৃষিকেন্দ্রিক উৎসব। ধান ওঠার সময়, অর্থাৎ নতুন ফসল ঘরে তোলার মৌসুমে, দেবী লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। কৃষকরা মনে করেন—যতটা ফসল তাঁরা বছরের পর বছর কঠোর শ্রম দিয়ে ফলিয়েছেন, সেটি দেবীর কৃপাই তাঁদের ঘরে এসেছে। তাই দেবীর উদ্দেশ্যে শস্য নিবেদন করা আসলে শ্রমফলকে সম্মান জানানোর এক সামাজিক রীতি।
গ্রামীণ জীবনে এই পূজায় নারী-পুরুষ সবার শ্রমের প্রতিফলন ঘটে। পুরুষেরা মাঠ থেকে ধান নিয়ে আসে, গোলায় তুলে রাখে; আবার গোয়ালঘর ও উঠোন পরিষ্কার করাও তাঁদের কাজের মধ্যে পড়ে। অন্যদিকে গৃহিণীরা ঘরদোর ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করেন, উঠোনে গোবর মেখে আলপনা আঁকেন, প্রদীপ জ্বালান, ধান-দুধ-দই প্রভৃতি সামগ্রী সাজান। শিশু-কিশোররা ফুল সংগ্রহ করে, প্রদীপে তেল ভরে দেয় এবং পূজার পরিবেশকে উজ্জ্বল করে তোলে। অর্থাৎ পরিবার ও সমাজের প্রতিটি স্তরে শ্রম ভাগাভাগি হয়, আর তার সমষ্টিগত রূপেই গড়ে ওঠে লক্ষ্মীপুজো।
এই পূজা এক অর্থে ‘শ্রমের আরাধনা’। গ্রামীণ সমাজে লক্ষ্মীপুজো হলো শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার উৎসব। দেবীর আরাধনা কেবল ভক্তির প্রকাশ নয়, বরং সেই ভক্তির মাধ্যমে মানুষ তাদের শ্রমের ফসল ও জীবনের শৃঙ্খলাকে পবিত্র করে তোলে।

শৃঙ্খলার দার্শনিক ব্যাখ্যা

লক্ষ্মীপুজোকে যদি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়, তবে স্পষ্ট বোঝা যায় যে এই উৎসব কেবল শ্রমের আরাধনা নয়, বরং শৃঙ্খলারও প্রতীক। বাংলার গ্রামীণ সমাজে দেবী লক্ষ্মীর আগমন মানেই এক সুশৃঙ্খল ও পরিচ্ছন্ন জীবনযাত্রার প্রতিফলন। প্রথমত, সঞ্চয়ের শৃঙ্খলা এখানে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিজীবী সমাজে খাদ্যই ছিল টিকে থাকার মূল ভরসা। নতুন ফসল ঘরে তোলার পর সেটি কীভাবে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হবে, কীভাবে অপচয় এড়ানো হবে, কীভাবে আগামী বছরের জন্য ধান গোলায় রাখা হবে—এসব বিষয়েই দেবী লক্ষ্মীর শিক্ষা নিহিত। ফলে পূজার আচার-অনুষ্ঠান এক ধরনের খাদ্য ব্যবস্থাপনার প্রতীকী রূপ। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা। লোকবিশ্বাসে বলা হয়, অযথা খরচ করলে লক্ষ্মী রুষ্ট হন। আসলে এই বিশ্বাসই মানুষকে মিতব্যয়িতা শেখায়। অর্থনীতির প্রাথমিক শিক্ষার মতোই এখানে বলা হয়েছে—সঞ্চয় ছাড়া সম্পদ দীর্ঘস্থায়ী নয়। তৃতীয়ত, সামাজিক শৃঙ্খলা। গ্রামে একসঙ্গে সবাই পূজা করলে সামাজিক ঐক্য বৃদ্ধি পায়। পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক দৃঢ় হয়। পূজা উপলক্ষে সমষ্টিগত শ্রম ও অংশগ্রহণ একধরনের সামাজিক সংহতি তৈরি করে। চতুর্থত, নৈতিক শৃঙ্খলা। প্রচলিত ধারণা হলো—সততা, পরিশ্রম ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জীবনধারা বজায় রাখলে দেবীর কৃপা লাভ হয়। অর্থাৎ শ্রম ও শৃঙ্খলার সঙ্গে যুক্ত থাকে নৈতিকতার বার্তাও। সবশেষে, লক্ষ্মীপুজোর মধ্যে লুকিয়ে থাকা এই শৃঙ্খলা কেবল গৃহস্থালির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সমাজের অর্থনৈতিক ও নৈতিক কাঠামোকেও দৃঢ় করে। তাই দেবী লক্ষ্মী এখানে কেবল ধনের দেবী নন, বরং শৃঙ্খলার দেবী, যিনি মানুষকে শেখান যে শ্রমে সম্পদ আসে, আর শৃঙ্খলায় সেই সম্পদ টিকে থাকে।

Bangla Jago fb page: https://www.facebook.com/share/17CxRSHVAJ/

ধর্ম বনাম জীবনযাপন:

একটি বিশ্লেষণ লক্ষ্মীপুজোকে অধিকাংশ মানুষ প্রথমে ধর্মীয় আচার হিসেবেই উপলব্ধি করে থাকেন। পূজার আসন, মন্ত্রপাঠ, প্রদীপ, ধূপ, ফুল ও নৈবেদ্য—সবকিছুই ধর্মীয় রীতির আবহ তৈরি করে। কিন্তু যদি বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করা হয়, তবে দেখা যায় যে এই পূজা আসলে ধর্মীয় সীমারেখাকে অতিক্রম করে জীবনযাপনের এক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ বহন করে।
ধর্মের উদ্দেশ্য সাধারণত ঈশ্বর বা দেবদেবীর আরাধনা। কিন্তু লক্ষ্মীপুজোর ক্ষেত্রে আরাধনা মানে কেবল দেবীর প্রতি ভক্তি নয়, বরং সেই ভক্তির মাধ্যমে মানুষ নিজেদের শ্রমফলকে মর্যাদা দেয় এবং জীবনের শৃঙ্খলাকে স্বীকার করে। কৃষক সমাজের কাছে দেবী লক্ষ্মী মানে নতুন ফসলের নিরাপত্তা, গৃহস্থালির সুশৃঙ্খল রক্ষণাবেক্ষণ, এবং পরিবারের জন্য খাদ্য ও সম্পদের নিশ্চয়তা। এখানে ধর্মীয় রূপটি আসলে এক আচ্ছাদন, যার ভেতরে নিহিত রয়েছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক শিক্ষা।
আবার লক্ষ্মীপুজোতে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের অংশগ্রহণও জীবনের পাঠ বহন করে। শিশুরা প্রদীপ সাজায়, নারী সদস্যরা ঘর পরিষ্কার ও আলপনা আঁকেন, পুরুষেরা ধান তোলেন ও সাজান। এভাবে সমষ্টিগত শ্রমের মধ্য দিয়ে যে ঐক্য তৈরি হয়, সেটি ধর্মীয় ভক্তির চাইতে অনেক বেশি সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনের প্রতীক।
সুতরাং, লক্ষ্মীপুজোকে শুধু ধর্মীয় আচার বললে তার প্রকৃত তাৎপর্য বোঝা যায় না। এটি হলো জীবনযাপনের নীতি—শ্রমের মাধ্যমে সম্পদ সৃষ্টি, শৃঙ্খলার মাধ্যমে সম্পদের সংরক্ষণ, এবং ঐক্যের মাধ্যমে সমাজের স্থিতিশীলতা। ধর্মীয় আবহে এই পূজা মানুষকে আসলে দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব ও প্রয়োজনীয় শিক্ষাই দিয়ে থাকে।

আধুনিক সমাজে লক্ষ্মীপুজোর প্রাসঙ্গিকতা

প্রাচীন কৃষিভিত্তিক সমাজে লক্ষ্মীপুজো মূলত ফসল তোলা, গৃহস্থালির শৃঙ্খলা রক্ষা এবং পরিশ্রমের মর্যাদা দেওয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু আধুনিক নগরসভ্যতায় এসে কি এই পূজার গুরুত্ব কমে গেছে? বাস্তবে দেখা যায়, সময় পাল্টালেও পূজার অন্তর্নিহিত দর্শন আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। প্রথমত, আধুনিক সমাজের অন্যতম সংকট হলো ভোগবাদী মানসিকতা। দ্রুত সাফল্যের প্রত্যাশা মানুষকে শ্রম ও সৎ উপার্জনের মূল্যবোধ থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। লক্ষ্মীপুজোর শিক্ষাই এখানে প্রাসঙ্গিক—এটি মানুষকে মনে করিয়ে দেয় যে সম্পদের ভিত্তি হলো পরিশ্রম, সততা এবং শৃঙ্খলা। অলসতা বা অনৈতিক উপায়ে অর্জিত সম্পদ স্থায়ী নয়, ঠিক যেমন লোকবিশ্বাসে বলা হয়—অলস ও অগোছালো সংসারে দেবী লক্ষ্মী স্থায়ীভাবে বাস করেন না। দ্বিতীয়ত, পরিবেশ সংকটের যুগে এই পূজা টেকসই জীবনযাপনেরও বার্তা বহন করে। ঘরদোর পরিষ্কার রাখা, ধান বা শস্যকে পূজার উপকরণ করা—এসবই প্রকৃতি ও জীবনের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার প্রতীক। আধুনিক সমাজ যদি এই বার্তাকে গ্রহণ করে তবে অপচয় কমবে এবং পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন সম্ভব হবে। তৃতীয়ত, পারিবারিক ও সামাজিক সংহতির ক্ষেত্রেও লক্ষ্মীপুজো আজও গুরুত্বপূর্ণ। শহুরে ব্যস্ত জীবনে পরিবার ভাঙনের প্রবণতা স্পষ্ট। কিন্তু লক্ষ্মীপুজোতে পরিবারের সবাই একত্রিত হয়, শ্রম ভাগাভাগি করে, আনন্দ ভাগ করে নেয়। এই সমষ্টিগত চর্চা আধুনিক সমাজে পারিবারিক বন্ধনকে দৃঢ় করার এক বিরল সুযোগ। সবশেষে, লক্ষ্মীপুজো অর্থনীতির এক বিকল্প দর্শনও সামনে আনে। আধুনিক অর্থনীতি যেখানে মুনাফা ও ভোগকেন্দ্রিক, সেখানে এই পূজা শ্রম, নৈতিকতা ও সংযমের ওপর জোর দেয়। ফলে, লক্ষ্মীপুজোকে শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং মানবসমাজের জন্য চিরন্তন নৈতিক-অর্থনৈতিক শিক্ষার উৎস বলা চলে।

শ্রম ও শৃঙ্খলার আরাধনা হিসেবে লক্ষ্মীপুজো

লক্ষ্মীপুজো মূলত দেবী লক্ষ্মীর প্রতি ভক্তি নিবেদনের মধ্য দিয়ে সম্পদের আরাধনা হলেও এর আসল তাৎপর্য নিহিত রয়েছে শ্রম ও শৃঙ্খলার আরাধনায়। প্রথমত, কৃষিনির্ভর সমাজে লক্ষ্মীপুজো নতুন ফসল ওঠার পর পালিত হয়। ধান, শস্য, ফলমূল—এসব শ্রমফলই দেবীর চরণে নিবেদন করা হয়। এই প্রতীকী প্রক্রিয়া মানুষকে শেখায় যে সম্পদের উৎস হলো মানবশ্রম। দেবী এখানে শ্রমফলের প্রতীক, অর্থাৎ দেবীকে পূজা করার অর্থ হলো নিজের পরিশ্রমকে মর্যাদা দেওয়া। দ্বিতীয়ত, পূজার আগে ঘরদোর পরিষ্কার করা, ধুলোবালি ঝাড়া, অগোছালো জিনিস সরানো ইত্যাদি কাজ আসলে শৃঙ্খলা ও পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস গড়ে তোলে। লোকবিশ্বাসে বলা হয়—অগোছালো বা অপরিষ্কার ঘরে দেবী প্রবেশ করেন না। এই বিশ্বাস আসলে একটি সামাজিক শিক্ষা: মানুষকে পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি ও নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করতে হবে। তৃতীয়ত, এই পূজায় সবাইকে অংশ নিতে হয়। শিশুরা প্রদীপ সাজায়, মহিলারা আলপনা আঁকেন, পুরুষেরা শস্য সাজান। এভাবে শ্রমের ভাগাভাগি ও সমষ্টিগত শৃঙ্খলার চর্চা হয়। ফলে লক্ষ্মীপুজো শুধু ব্যক্তিগত পূজা নয়, বরং একটি সমবেত শ্রমচর্চার প্রতীক। চতুর্থত, লক্ষ্মীপুজো একধরনের নৈতিক শিক্ষাও বহন করে। বলা হয়, যেখানে অলসতা, মিথ্যা বা অপচয় রয়েছে, সেখানে দেবী স্থায়ীভাবে থাকেন না। এই প্রতীকী বার্তাটি মানুষের মধ্যে সততা, মিতব্যয়িতা ও অধ্যবসায়ের বোধ জাগায়।
বাংলার গ্রামীণ ও আধুনিক সমাজে লক্ষ্মীপুজো কেবল একটি ধর্মীয় আচার নয়। এটি হলো শ্রম, শৃঙ্খলা, সঞ্চয় ও সামাজিক সংহতির প্রতীক। প্রাচীন কৃষিজীবী সমাজে নতুন ফসলের সঙ্গে দেবীকে সংযুক্ত করা হয়েছিল একদিকে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার জন্য, অন্যদিকে ঘর-সংসারের সুশৃঙ্খল রক্ষার শিক্ষা দিতে। দেবী লক্ষ্মী এখানে কেবল সম্পদের দেবী নয়, বরং শ্রম ও শৃঙ্খলার আরাধনার প্রতীক। গ্রামীণ সমাজে প্রতিটি সদস্যের অংশগ্রহণ, ঘরদোর পরিচ্ছন্নতা, ধান ও শস্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা—এসবই প্রদর্শন করে যে সমাজে সমষ্টিগত শৃঙ্খলা এবং পরিশ্রমের গুরুত্ব অপরিসীম। আধুনিক নগরজীবনেও এই শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা অক্ষুণ্ণ; ভোগবাদ, অলসতা ও অপচয় থেকে মানুষকে বিরত রাখার জন্য লক্ষ্মীপুজো এখনও প্রাসঙ্গিক। ফলে, লক্ষ্মীপুজোকে যদি শুধু ধর্মীয় আচার হিসেবে দেখা হয়, তাহলে তার প্রকৃত তাৎপর্য বোঝা যায় না। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি জীবনের পাঠ, যা শেখায়—পরিশ্রম ছাড়া সমৃদ্ধি আসে না, শৃঙ্খলা ছাড়া সম্পদ স্থায়ী হয় না, এবং সামাজিক সহযোগিতা ছাড়া মানবজীবন সমৃদ্ধ হতে পারে না। অতএব, সঠিক অর্থে বলা যায়—লক্ষ্মীপুজো ধর্ম নয়, জীবনযাপনের শৃঙ্খলা ও শ্রমের আরাধনা। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি পরিশ্রম, প্রতিটি সঞ্চয়, প্রতিটি সুশৃঙ্খল কাজই প্রকৃত অর্থে ঐশ্বর্য এবং স্থায়ী সমৃদ্ধির মূল।