গ্রাফিক্স: নিজস্ব
নয়ন কুইরী, পুরুলিয়া: “মোরা একই বৃন্তে দুইটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান “- কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘হিন্দু-মুসলিম’ কবিতার প্রথম লাইনটি যেন আজও অটুট রয়েছে এই বাংলার মাটিতে। তা পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাস্তব জীবনে দুটি কুসুম দেখা গিয়েছে। এক ছাদের তলায় দুই সম্প্রদায়ের দেবতার বিরাজমান। রয়েছে এক মন্দির আরেক মন্দিরের ভিতরে। সেখানে বিরাজমান রয়েছে শ্রী শ্রী মা ভদ্র কালী ও বাবা সত্য পীরের মন্দির আর এমনই এক অদ্ভুত ও অবাক করা কাহিনী লুকিয়ে আছে রুখা শুখা মাটির জেলায় (Unity Worship)। সেটি কী জানেন?
পুরুলিয়া শহর থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে রয়েছে হিঁড়বহাল নামে এক প্রত্যন্ত ছোট্ট গ্রাম। আর এই গ্রামেই ভিতরেই এক মন্দিরের ভিতরেই বিরাজমান করেছে দুই সম্প্রদায়ের শ্রী শ্রী মা ভদ্র কালী ও বাবা সত্য পীরের মন্দির। এই গ্রামে, বাউরী সম্প্রদায়ের উদ্যোগে নিত্যদিন মায়ের পুজো হয়। পুরুলিয়ার হিড়বহালে ৫০০ বছর ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক কালী পুজো।
লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/Banglajagotvofficial
বর্তমান সময়েও বাংলার এই কোণে এক গ্রাম চিরসবুজ শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা বহন করে আসছে। পুরুলিয়া জেলার হিড়বহাল গ্রাম, শহর থেকে মাত্র ১৪ কিমি দূরে, প্রায় ৫০০ বছর ধরে একই মন্দিরে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ ভদ্রকালী ও সত্য পীর বাবার পুজো করছে। (Unity Worship)

গ্রামের মন্দিরটি অন্যান্য মন্দিরের থেকে আলাদা। এখানে কোন ব্রাহ্মণ পুরোহিত নেই। বরং বাউরি সমাজের পরিবারগুলোই পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন। মন্দিরে ৩৬৫ দিন নিয়ম মেনে পুজো হয়। কালী পুজোর সময়ও হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রিত হয়ে অংশগ্রহণ করেন। মন্দিরে বলি প্রথাও চালু আছে। জেলার সীমা ছাড়িয়ে রাজ্য ও ভিন্ন রাজ্য থেকে সারাবছরে ভক্তদের আনাগোনা থাকে এই মন্দির।
বর্তমানে মন্দিরের সেবায়েত তপন বাউরী জানান, “এর আগে বাবা পুজো করতো এখন আমি পুজো করি”। এই মন্দিরের ইতিহাস সম্পর্কে জানা গিয়েছে, প্রায় ৫০০ বছর পূর্বে এই এলাকা এক গভীর জঙ্গল বেষ্টন করেছিল। তৎকালীন এই জঙ্গলে এক সাধক তপস্যা করছিলেন। মা কালীর স্বপ্নাদেশ এবং মায়ের আদেশ পেয়ে তিনি পুজোর সূচনা করেন। এই গভীর জঙ্গলে সাধকের একাধিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। বলা হয়, জলের তলায় সাত দিন ডুবিয়ে রাখেন মা কালী। একাধিক পরীক্ষায় সাধক উত্তীর্ণ হলে পর মা একটা খড়্গ দেন সাধককে। আর মায়ের নির্দেশই মতো একদিকে ধ্যান অন্যদিকে সাধক মায়ের তপস্যা এবং পুজো শুরু করেন জঙ্গলের ভিতরে। এরপর কিছুদিন মায়ের পুজো করার পর, ওই জঙ্গলে থাকা সাধকের চোখে পড়ে জঙ্গলের ভিতরে ঘোড়ায় চেপে কোন এক ব্যক্তি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এই ঘটনা সাধকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। (Unity Worship)

পরে মুসলিম সম্প্রদায়ের এক ফকির বাবা সত্যপীরের রুপে সাধকের নিকটে আবির্ভূত হন। অরণ্য জঙ্গলে থাকা ওই হিন্দু সম্প্রদায়ের সাধককে পরামর্শ দেন, যে আমি মায়ের সঙ্গে পুজিত হতে চাই একই মন্দিরে। এই প্রশ্নের উত্তরে জঙ্গলে তপস্যা করা সাধক সত্য পীর বাবাকে জানিয়েছিলেন, আমি হিন্দু সম্প্রদায়ের দেবীকে পুজো করি। আমি কীভাবে মুসলমান সম্প্রদায়ের দেবতাকে, একইসঙ্গে পুজো করব? এই নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান সাধক। ওই সত্যপীরের কথা তিনি এড়িয়ে যেতে পারেননি। একাধিক চিন্তাভাবনার পর জঙ্গলে থাকা সাধক তিনি নিজের হাতে মা ভদ্র কালী ও বাবা সত্যপীর বাবার পুজো চালিয়ে যান। সেই নির্দেশে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায় একত্রে পুজো শুরু করেন, যা আজও অব্যাহত।
বর্তমানে পুরুলিয়ার ওই প্রত্যন্ত হিঁড়বহাল গ্রামে বাউরী সম্প্রদায়ের মানুষজনই এই মেলা এবং মন্দিরের পরিচালনা করেন। প্রতি বছরের মাঘ মাসের প্রথম দিনে এই মন্দিরে একটা মেলার আয়োজন করা হয়। হিড়বহালের এই মন্দির শুধু ধর্মীয় নয়; এটি বাংলার হৃদয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক জীবন্ত প্রতীক। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এখানে আসে, ভেদাভেদের সীমা ভুলে মিলেমিশে আধ্যাত্মিক শান্তি লাভ করে। এই গ্রাম প্রমাণ করে যে, শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংযমের মাধ্যমে মানুষ ধর্মের ভেদাভেদকে পেছনে ফেলে একত্রিত হতে পারে। (Unity Worship)