ad
ad

Breaking News

Chandi Devi Temple

মশাল হাতে রে-রে করে দাপিয়ে বেড়াতো ডাকাতের দল, বিরহীর চণ্ডীদেবীর মন্দিরের গল্পগাঁথা

কথিত আছে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে মদনগোপাল-এর মূর্তি ছিল, কিন্তু পাশে রাধার মূর্তি ছিল না, স্বভাবতই তিনি বিরহে কাতর ছিলেন।

A gang of robbers roamed around with torches in their hands, the story of the Chandi Devi temple in Birhi

গ্রাফিক্স: নিজস্ব

ইন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়: নদিয়ার বিরহী গ্রাম, যার সঙ্গে জড়িয়ে অতীতের অনেক গল্পগাঁথা, অনেক স্মৃতি, অনেক পুরনো ইতিহাস। কথিত আছে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে মদনগোপাল-এর মূর্তি ছিল, কিন্তু পাশে রাধার মূর্তি ছিল না, স্বভাবতই তিনি বিরহে কাতর ছিলেন। স্বপ্নে তা প্রকাশ পায়। পরে অবশ্য যমুনা নদী দিয়ে ভেসে আসা নিমকাঠ দিয়ে তৈরি হয় রাধার মূর্তি। মদনগোপাল-রাধার বিরহ থেকেই নাকি নাম হয় বিরহী। সেই সময় নাকি কোনও এক রসিক কবি গান বেঁধেছিলেন- বিরহীর মদনগোপাল বউ ছেলে নেই পোড়াকপাল!

এর একেবারে কাছেই আরও একটি মন্দির রয়েছে। টেরাকোটার তৈরি চণ্ডীদেবীর মন্দির। যার আনুমানিক বয়স ৭০০ বছর। কালের করাল-গ্রাসে তার অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। ভেঙে ভেঙে পড়ছে ইট, কাঠ, কড়ি, বরগা। বারবার দাবি উঠেছে মন্দির সংস্কার ও হেরিটেজ স্বীকৃতির।
একসময় মাটির প্রদীপ, হ্যারিকেন, হ্যাজাক এর আলো ব্যবহার হতো। আজকের মতো বিদ্যুতের বাতি নয়। ছিল না আজকের মতো আধুনিকতার ছোঁয়া, ঝাঁ চকচকে রাস্তা-ঘাট, পরিবহন ব্যবস্থা। ঘন জনবসতিও ছিলনা। দূরে দূরে এক একটি গ্রাম, জঙ্গল, আর তার ভেতর দিয়ে রাস্তা। পরিবহণ বলতে জলপথ, গরু-ঘোড়ার গাড়ি।

অবশ্য বেশিরভাগ মানুষই হেঁটে চলাফেরা করতেন। কোনও কোনও জায়গায় গড়ে উঠেছিল জনবসতি আবার কোথাও বা জনহীন এলাকা। রাতের আঁধারে পথিক সেই সময় মেঠো পথ ধরে গান গাইতে গাইতে চলতেন, তাড়াতাড়ি তার গন্তব্যে পোঁছানোর আশায়। সন্ধ্যায় নেমে আসা অন্ধকারের জঙ্গলে হাড়হিম করা এক ভৌতিক পরিবেশ, আর এই অন্ধকারের বুকচিরে মাঝে মাঝে ছোট ছোট জনবসতি। জনবসতিতে টিমটিমে আলো দেখা যেত। বয়ে যাওয়া যমুনা নদীর ধারে অবস্থিত চণ্ডীদেবীর মন্দিরে ছিল ডাকাতের আস্তানা। কথিত আছে, ঘন জঙ্গলে ঢাকা রাতের ঘন অন্ধকারে মশাল হাতে রে রে করে দাপিয়ে বেড়াতো ডাকাতের দল।

চন্ডীদেবীর পুজো দিয়ে তারা ডাকাতির উদেশ্যে রওনা দিত। তাদের বিশ্বাস ছিল দেবীর আশীর্বাদ বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করবে, মিলবে সফলতা। ডাকাতিতে সফল হয়ে ফিরে আসার পরও তারা দেবীর আরাধনা করতেন। সচারচর ওই জঙ্গলে সেইসময় কেউ প্রবেশ করতো না। কিন্তু চিরদিন তো কারও দিন সমান যায়না, অন্যদিনের মতো সেদিনও তারা ডাকাতি করতে বেরিয়েছিল। কিন্তু সফল হয়নি, ডাকাতদের দুজন সঙ্গী ধরা পড়ে যায়। বাকিরা প্রাণ হাতে পালিয়ে আসে।

তারা চণ্ডীদেবীর মন্দিরের আস্তানায় দেবীর ওপর রাগান্বিত হয় এবং অপ্রকৃতিস্ত অবস্থায় দেবীর বিগ্রহ কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলে। তাতে চণ্ডীদেবীর কোপ পড়ে তাদের ওপর। ডাকাতদের মুখ দিয়ে রক্ত উঠতে থাকে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের মৃত্যু ঘটে। এর পাশাপাশি আরও একটি কাহিনী মানুষের মুখে মুখে ফেরে। একজন তান্ত্রিক নাকি সেখানে সাধনা করতেন। ওই তান্ত্রিকের বহুদিনের ইচ্ছা সে নরবলি দেবে চণ্ডীদেবীর কাছে। কিন্তু সাধারণত তো এই গভীর জঙ্গলের রাস্তায় কেউ আসেনা, ভুল করেও না, কোনও একদিন একটি ফুটফুটে সুন্দর ছোট্ট মেয়েকে দেখা গেল, তান্ত্রিক আশার আলো দেখলো।

সে বলির উদ্দেশ্যে নিয়ে গেল মন্দিরের সামনে, হাঁড়িকাঠে তার গলা দিয়ে তান্ত্রিক খাঁড়া উচিয়ে বলি দিতে যখন উদ্যত হয়, তখন সে ছোট্ট মেয়েটির মধ্যে দেবী চণ্ডীকে দেখতে পেল, অন্ত্রিক চমকে উঠলো, কেঁদে ফেললো। সে মনে মনে ভাবলো একি করছিল সে? প্রায়শ্চিও করতে সে ওই খাঁড়া দিয়েই নিজের শির কাটতে উদ্যত হল, কিন্তু অদৃশ্য দেবী শক্তি তার হাত ধরে ফেললো, আকাশ বানী হল, একি করছিলি তুই, আত্মহত্যা মহাপাপ তা জানিস না? তোর অনুশোচনা হয়েছে এটাই যথেষ্ট। তান্ত্রিক বললো ক্ষমা করো মা, তারপর থেকেই তান্ত্রিক উধাও হয়ে যায়।

মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনা নদীতে একসময় নাকি জোয়ার ভাঁটা হতো। জলপথে নৌকা-বজরার মাধ্যমে চলতো ব্যবসা-বানিজ্য। ইংরেজ আমলে নাকি জলপথে যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল। মন্দিরের কাছে সাহেবদের একটি নীলকুঠিও ছিল, যার ধ্বংসাবশেষ আজও বিদ্যমান। বিরহী বাজারের বুক চিরে বেরিয়ে যাওয়া কলকাতা- বহরমপুর বর্তমানে ১২ নম্বর জাতীয় সড়ক।

মদনাপুর রোড দিয়ে কিছুটা পথ হাঁটলে প্রথমে মদন-গোপাল মন্দির, তার কাছেই চণ্ডী দেবীর মন্দির। এখনও অনেকে এই চণ্ডী মন্দিরে পুজো দেন, মনস্কামনা পূর্ণের আশায়। মন্দিরে ভাড়া বাঁধেন, বহু দূরের মানুষও এই মন্দির দর্শন করতে আসেন।
হরিণঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির শিক্ষা, ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও যুব কল্যাণ দফতরের স্থায়ী সমিতির কর্মাধ্যক্ষ সুপ্রতিম রায় বলেন, বিরহী গ্রামের শুধু মদন-গোপাল ও চন্ডীদেবীর মন্দিরই নয়, অনেক অজানা কথা, অজানা ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে।

৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক বর্তমানে ১২ নম্বর রোড, এক সময় এটা ছিল ‘বাদশাহী রোড’। ১৭৫৭ সালে এই রাস্তার ওপর দিয়েই পলাশীর যুদ্ধ জয় করে লর্ড ক্লাইভ কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন। ইতিহাস, গল্পগাঁথা, কল্পনা নিয়েই বিরহী গ্রাম। বিরহীর মদন-গোপাল আর চন্ডীরামপুরের চণ্ডীদেবীর মন্দির। সনাতনী ও ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সহাবস্থান, সন্ধ্যায় মন্দিরে ঘন্টা, কাঁসর, উলুধ্বনি আর মসজিদে আজানের ধ্বনি বাতাসে মিশে একাকার হয়ে যায়।